করোনা মোকাবিলায় জার্মানি যে ব্যবস্থা নিয়েছে

করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর মাস্কসহ নানা সুরক্ষা নিয়ে বাইরে বের হন জার্মানরা। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর মাস্কসহ নানা সুরক্ষা নিয়ে বাইরে বের হন জার্মানরা। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের সর্বত্র করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের সেরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা থাকা সত্ত্বেও জার্মানি এখন বিশ্বে পঞ্চম করোনাভাইরাস সংক্রমিত দেশ। গতকাল শনিবার পর্যন্ত জার্মানিজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজার ৩৬৪, আর এই ভাইরাসে মারা গেছে ৮৪ জন।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম জার্মানিতেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। জার্মানির উত্তর রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে পাঁচ ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়। ওই রাজ্যের হাহাইসনবার্গ জেলার গ্যাংগেল্ট নামক স্থানে একটি স্থানীয় কার্নিভ্যাল উৎসবে প্রায় তিন শ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। মূলত কার্নিভ্যাল উৎসবে যাওয়া কয়েক ব্যক্তির মধ্য এই রোগের প্রথম সংক্রমণ দেখা যায়।

প্রথম দিকে বিষয়টি ততটা গুরুত্ব বা সংক্রমণের হার ততটা না বাড়লে জার্মানি সরকার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। জার্মানি সরকার ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে জার্মানির ১২০ জন নাগরিককে বিশেষ সামরিক বিমানে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরিয়ে এনে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যায়।

এরপর ১১ মার্চ জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ইয়েন স্পান ও জার্মানির সংক্রমণ রোগ বিষয়ের গবেষণা কেন্দ্র রবার্ট কক ইনস্টিটিউটের সভাপতি লোথার ভিলারের সমন্বয়ে করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে আঙ্গেলা ম্যার্কেল বিশেষজ্ঞদের অভিমত নিয়ে বলেন, জার্মানিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।
এরপর জার্মানিজুড়ে আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়। এরপর শুরু হয়ে যায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের নানা উদ্যোগ। জার্মানির জনগণ সর্বত্র এই উদ্যোগে সহায়তা ও সহযোগিতা করছে।

১. ২৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসন্ন করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

২. ২ মার্চ জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন স্পান, ছয়জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জার্মানির জনগণকে করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি অবহিত করেন।

৩. জার্মানির পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর প্রতিদিন জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী, জার্মানির সংক্রমণ রোগ বিষয়ের গবেষণা কেন্দ্র রবার্ট কক ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নানা করণীয় বিষয়ে টেলিভিশনে লাইভ সংবাদ সম্মেলন করেন।

৪. ১১ মার্চ জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন স্পান ও জার্মানির সংক্রমণ রোগ বিষয়ের গবেষণা কেন্দ্র রবার্ট কক ইনস্টিটিউটের সভাপতি লোথার ভিলারের সমন্বয়ে সংবাদ সম্মেলন করে, সবাইকে করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে অবহিত করেন।

৫. ১৩ মার্চ স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে, স্কুলগুলোতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সব ছাত্রকে চিঠি বিতরণ করে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করে। ক্লাস শিক্ষয়িত্রী ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী দুই সপ্তাহের হোমটাস্ক দিয়ে দেয়।

৬. ১৬ মার্চ থেকে কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, থিয়েটার, অপেরা, জনপ্রিয় ফুটবল খেলা, বাণিজ্য মেলা বা ১ হাজার লোকের বেশি যেকোনো অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই সর্বত্র লোকসমাগম থেমে যায়।

৭. ১৮ মার্চ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল সন্ধ্যায় জার্মান জাতির উদ্দেশে এক আবেগপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঠেকাতে বেশ কিছু বিধি জারি করেন। যা স্বল্প পরিসরের জরুরি অবস্থা বলে বিবেচিত হচ্ছে। সেই বিধি অনুযায়ী জার্মানির ১৬ রাজ্যে, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সুপার মার্কেট, ওষুধের দোকান, স্যানিটারিজ, পেট্রলপাম্প, ব্যাংক, ডাকঘর ইত্যাদি ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ রাখতে হবে। হোটেল ও রেস্টুরেন্টসমূহ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রেস্টুরেন্টসমূহ থেকে অন্যত্র খাদ্য ডেলিভারি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সব ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সমস্ত বার, ক্লাব, থিয়েটার, চিড়িয়াখানা, পাবলিক সুইমিংপুল, শিশুদের খেলার স্থান, খেলার মাঠ এবং পতিতালয় বন্ধ রাখতে হবে। জার্মানিতে সব ধরনের অবকাশ যাপন ও অন্য দেশে অবকাশভ্রমণ আপাতত বন্ধ থাকবে।

৮. করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হয়েছে মনে করলে বাড়ি থেকে জরুরি চিকিৎসাসেবার ফোন নম্বরে ফোন করতে হবে। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করবেন বা অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে যাবে। অথবা নিজস্ব চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বাইরে থেকে খবর দিতে হবে। বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, জার্মানির রেডক্রস করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আলাদা কেন্দ্র খুলেছে।

৯. জার্মানিতে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বাড়তি সহযোগিতার জন্য, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিযুক্ত করা হয়েছে। সরকার এই খাতে আলাদা অর্থ বরাদ্দ করেছে।

১০. বয়স্ক মানুষের জরুরি সেবা ও কেনাকাটার জন্য প্রতিবেশীদের সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।

১১. সুপার মার্কেটগুলোতে কিছু কিছু পণ্য দুই বা তিনটির বেশি না ক্রয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে চাল, ময়দা, নুডলস, টয়লেট পেপার ইত্যাদি। তবে কোথাও কোনো পণ্যের মূল্য বাড়েনি।

১২. পুলিশ অকারণে বা দলবদ্ধ হয়ে কেউ ঘুরলে, জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে।

১৩. বিয়ে, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।

১৪. রাস্তাঘাট, দোকানপাটে সর্বত্র মানুষজন দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। যাকে এই মুহূর্তে ‘সোশ্যাল ডিসটেনস’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

১৫. জার্মানি সরকার সর্বত্র ছোটবড় ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তাদের ক্ষতিপূরণের একটি অংশ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।

১৬. জার্মানি সরকার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবসরযাপন করতে যাওয়া প্রায় ১ লাখ নাগরিককে সরকারি খরচে বিশেষ বিমানে জার্মানিতে ফেরত আনছে।

১৭. জার্মানির ১৬ প্রদেশের মধ্য ব্যাভেরিয়া ও সারল্যান্ডে ইতিমধ্যেই লকডাউন বলবৎ হয়েছে। তবে ২৩ মার্চ থেকে এই লকডাউন জার্মানিজুড়ে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে সোমবার জার্মানির মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই জার্মানির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা রাজনীতিবিদদের কাছে প্রাথমিকভাবে জার্মানিতে প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য অস্থায়ী লকডাউন করার দাবি জানিয়েছে। জার্মানি দেশজুড়ে লকডাউন চালু করলে ইতালি, ফ্রান্সের পর জার্মানি হবে ইউরোপের তৃতীয় দেশ, যারা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে সমগ্র দেশে অচলাবস্থা ঘোষণা করছে।