ভবিষ্যতে বৈশ্বিক নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র না চীন, প্রশ্নটা তুলেই দিল করোনা

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বই একরকম স্থবির হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে সত্যিকার অর্থেই একটি বৈশ্বিক ঘটনা বলা যায় এই ভাইরাসকে। এটি যেন সেই কথিত ইথার, যাকে দেখা না গেলেও থাকে সবখানেই। আর তাই অঞ্চল নির্বিশেষে ঘর-বাহির সব একাকার। জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোনো পরিচয়ই একে প্রতিহত করতে পারছে না। ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে প্রায় সব দেশ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। তবে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও এর বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে সম্ভবত সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোর বর্তমান হর্তাকর্তা যুক্তরাষ্ট্র।

বৈশ্বিক নেতৃত্বের বদলের ধরনটি হচ্ছে, শুরুতে অতি ধীরগতিতে এর বদল শুরু হয়। পরে হঠাৎ করেই দেখা যায় সব ওলট–পালট হয়ে গেছে। এত দিন বিশ্বের নেতৃত্ব যে গোষ্ঠীর হাতে ছিল, এখন আর তা নেই। নতুন কোনো নেতার কাছ থেকে আসছে আদেশ, নিষেধ বা দিকনির্দেশনা। এ ধরনের ঘটনা সর্বশেষ দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে। আরও ভালো করে বললে ১৯৫৬ সালে।

বৈশ্বিক নেতৃত্বের গৌরব নিয়ে ব্রিটিশ সূর্যের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত যাওয়ার শুরু তারও আগে থেকে। তবে এর গতি ছিল ধীর। বিষয়টা অনেকটা এমন ছিল যে ব্রিটিশ রাজ দয়া করে বিভিন্ন উপনিবেশ যেন ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আদতে অতটা সরল ছিল না, যা স্পষ্ট হয় ১৯৫৬ সালে সুয়েজে ব্রিটিশদের গা-জোয়ারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের পতন ঘনিয়ে আনার মধ্য দিয়ে। গামাল আবদুল নাসেরের মিসরে ব্রিটেনের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফ্রান্স ও ইসরায়েল। কিন্তু জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে মিসর ছাড়তে বাধ্য হয় যুক্তরাজ্য। এই একটি ঘটনাই সারা বিশ্বে নতুন শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মান্যতা দেয়। একই সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে অনেকটা নীরবেই মুছে দেয় যুক্তরাজ্যকে।

বর্তমানে করোনাভাইরাস ঠিক এমনই এক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যথাযথভাবে সাড়া দিতে না পারলে তাকেও নীরবে হয়তো তখ্‌ত ছেড়ে দিতে হবে। নতুন করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে ‘সুয়েজ মোমেন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে, ১৯৫৬ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনাটি বেশ স্পষ্টভাবে টানা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এও তেমনই এক মুহূর্ত। শুধু এ দৃশ্যের কুশীলবদের নামগুলো পাল্টে গেছে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে নিজের রাজ প্রতিষ্ঠা করা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দুর্বল দিক এই বৈশ্বিক মহামারি প্রকাশ করে দিয়েছে। একইভাবে নতুন দিকনির্দেশক হিসেবে সামনে চলে এসেছে চীনের নাম।

চীনে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু গত বছরের শেষ নাগাদ। দেশটির কর্তৃপক্ষকে সেখানকার একজন চিকিৎসক বিষয়টি সম্পর্কে সতর্কও করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে আটক করার সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পর্কিত তথ্য গোপনের পথ নেয় চীনা প্রশাসন। সেই জায়গা থেকে ওই চিকিৎসকের মৃত্যু এবং করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির রূপ নেওয়ার ঘটনাপরম্পরা এখন পুরো বিশ্ব জানে। এই চীনই আবার চলতি মাসে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিয়েছে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, এ সময়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ মহল বলছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনা মডেল অনুসরণ করা উচিত।

চীন কোন মডেল অনুসরণ করেছে বা কেন তাদের মডেল বেশি কার্যকর হয়েছে—সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গটি হলো, করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট থেকে শুরু করে এর সংক্রমণ রোধে কার্যকর উপায়, বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহসহ নানা কারণে এই দুর্যোগ মুহূর্তে সবাই চীনের দিকে তাকিয়ে আছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের দেওয়া বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ও দিকনির্দেশনামূলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে দুর্যোগময় পরিস্থিতির সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া বক্তব্য সংশয় ও অনিশ্চয়তাই তৈরি করেছে। যেকোনো বড় বিপর্যয়ে সারা বিশ্ব যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকত, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশটির সরকারি-বেসরকারি উভয় অংশের প্রস্তুতিই সবচেয়ে খারাপ ছিল। ‘পর্যাপ্তসংখ্যক পরীক্ষা করানো হচ্ছে না’ বলে দুই সপ্তাহ আগেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মার্কিন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা। আর এর মধ্য দিয়েই ইউরোপের সঙ্গে সব দরজা বিনা আলোচনায় বন্ধ করে দেওয়া ট্রাম্প প্রশাসন প্রমাণ করে দিয়েছে যে দুর্যোগে ‘একলা চলো’ নীতি নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র আদতে সংকট মোকাবিলায় কতটা অপ্রস্তুত।

ফরেন পলিসির ভাষায়, সাত দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র শুধু অর্থ ও ক্ষমতা দিয়েই বৈশ্বিক নেতায় পরিণত হয়নি। যেকোনো সংকটে বিশ্বের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা, গণতান্ত্রিক সুশাসন ব্যবস্থা, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে সংকট মোকাবিলার মানসিকতা—এসবই তাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল। কিন্তু সেই আসনে বসে সে একটু একটু করে নিজের এই সব যোগ্যতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সুফলটি হচ্ছে এই যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেই নেতৃত্বগুণ হারিয়ে ফেলার বিষয়টিকে সবার সামনে দৃশ্যমান করে দিয়েছে। নেতৃত্বের প্রতিটি মানদণ্ডেই এখন পর্যন্ত ওয়াশিংটন নিজেকে ব্যর্থ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।

ওয়াশিংটন যখন ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক তখনই জোর কদমে এগিয়ে চলেছে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা সে বুঝতেই দিচ্ছে না। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা থেকে ওয়াশিংটনকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আখ্যা দিয়ে নানা পরামর্শ ও সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে স্বপ্রণোদিত হয়েই পথ দেখাচ্ছে চীন। বৈশ্বিক মহামারি রুখতে নিজেদের মানচিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে সবার হয়ে কথা বলছে ও কাজ করছে দেশটি। আর এর মাধ্যমে শুরুতে ভাইরাসটির সংক্রমণের কথা গোপন করার বিষয়টিকেও গৌণ করে তুলতে পারছে তারা। মানুষ তার শুরুর অপরাধকে ক্ষমা করে দিচ্ছে। কারণ, তারা মহামারি মোকাবিলায় চীনের আন্তরিকতাই দেখছে। চীন যদি শেষ পর্যন্ত এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে যেতে পারে, তবে তা এত দিনের বৈশ্বিক কাঠামোটিই উল্টে দিতে পারে। সিংহাসনের নতুন আরোহী হতে পারে সি চিন পিংয়ের দেশটিই।

এই করোনাভাইরাসের মহামারি চীনসহ বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী দেশের শাসকদের আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে। সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি বিদেশি সাংবাদিক বিতাড়নের মতো প্রচুর ঘটনা ঘটছে। চীনেই যেমন বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের পর এবারই প্রথম সবচেয়ে বেশি বিদেশি সাংবাদিককে দেশটি থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সবাইকে চীনা মডেল অনুসরণের কথা বললেও একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় এর প্রয়োগ তুলনামূলক কঠিন হবে।

কারণ চীনা মডেলের সাফল্যের অন্যতম কারণ ‘কর্তৃত্ববাদই’। ব্যবসা-বাণিজ্যে চীনা মডেলের কথা এত দিন বলা হলেও সঙ্গে সমালোচনা হিসেবে ‘কর্তৃত্ববাদ’-এর কথা তুলে একটু সমালোচনাও করা হতো। কিন্তু এখন করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চীনের সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে এই ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটির সামনে আসাটা যেন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে এক বড় ঠাট্টা। মানুষ এই মুহূর্তে বাঁচতে চায়, যাকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে চীন নিজেকে সামনে নিয়ে আসছে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অবজ্ঞা করার মধ্য দিয়েই ওয়াশিংটন দৃশ্যপট থেকে অন্তত এখন পর্যন্ত তিরোহিত হয়েছে।

তবে এই লড়াইয়ের শেষ খেলাটি রয়েছে তার হাতেই, যে এই মহামারি রোধে ওষুধ ও টীকার খোঁজ দিতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়েছে। জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশও এগিয়ে আছে, যাদের সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রের পকেটেই ঢোকার সম্ভাবনা বেশি। লড়াইটি অনেক আগে থেকে শুরু করায় চীনও স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে। এ এক নীরব যুদ্ধ, বিশ্বের কোটি মানুষকে বাঁচানোর ছলনায় যা বিশ্ব শাসনের এক লড়াই বলা যায়।

কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি এবং করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আগামী দিনগুলোয় এ লড়াইয়ে যে নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে, বৈশ্বিক নেতৃত্বও তার দিকেই ঝুঁকবে নিঃসন্দেহে। তবে চূড়ান্ত সমীকরণ যা-ই হোক, বা লড়াইয়ে বিজয়ীর নাম যা-ই হোক না কেন, তার পক্ষে চীনকে অস্বীকার করাটা আর বোধ হয় সম্ভব হবে না। বরং তার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই পরবর্তী বিশ্বকাঠামোটি নির্মিত হবে বলা যায়।