করোনাভাইরাসের আগে ক্ষুধার ভয় মারবে তাদের

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধে ভারত পুরো দেশ লকডাউন করেছে। ছবি: এএফপি
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধে ভারত পুরো দেশ লকডাউন করেছে। ছবি: এএফপি

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধে ভারত পুরো দেশ লকডাউন করেছে। লোকজনকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে। তবে ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষের জন্য এই ব্যবস্থা মেনে চলা কঠিন। গতকাল মঙ্গলবার দেশটি জুড়ে লকডাউন ঘোষণার পর এই দিনমজুরেরা কীভাবে জীবন যাপন করছেন, তা আজ বুধবার বিবিসির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

দিল্লির নয়ডায় লেবার চকে নির্মাণশ্রমিকেরা লাইন ধরে বসে থাকেন। ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো সেই শ্রমিকদের ভাড়া করে।

গত রোববার প্রাথমিক লকডাউনের সময় প্রতিবেদক সেই এলাকা ঘুরে দেখেন, তা সুনসান পড়ে রয়েছে। ওই রকম একটি ব্যস্ত এলাকায় কেউ যা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেননি, তা–ই শোনা গেছে, পাখির কিচিরমিচির ডাক। পাখির ডাক শুনে প্রতিবেদক নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এক কোণে বসে আছেন কিছু লোক।

নিরাপদ দূরত্ব রেখে প্রতিবেদক তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন, যাঁদের একজন উত্তর প্রদেশের বান্ডা জেলার রমেশ কুমার।

রমেশ বললেন, ‘আমি দিনে ৬০০ রুপি আয় করি। এ দিয়ে চলে পাঁচজনের সংসার। অল্প দিনের মধ্যেই ঘরে খাবার ফুরিয়ে যাবে। আমি করোনাভাইরাস ভয় করি। কিন্তু আমি আমার ছেলেমেয়েকে অভুক্ত দেখতে পারি না।’

ভারতে কোটি কোটি দিনমজুরের অবস্থা রমেশের মতো। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লকডাউন ঘোষণার পর আগামী তিন সপ্তাহের জন্য তাঁরা আয়ের আর পথ দেখছেন না।

ভারতে ৫০০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছে ১০ জন। উত্তরের উত্তর প্রদেশ, দক্ষিণের কেরালা, রাজধানী দিল্লিসহ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার রমেশের মতো দরিদ্র মানুষকে সরাসরি অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

মোদি সরকারও লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দিনমজুরদের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুসারে, ভারতে কমপক্ষে ৯০ শতাংশ কর্মশক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তারা নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিকশাওয়ালা, হকার, ময়লা সংগ্রহকারী এবং গৃহকর্মী।

বেশির ভাগের পেনশন, অসুস্থতাজনিত ছুটি, বেতনসহ ছুটি বা কোনো ধরনের বিমা–সুবিধা নেই। অনেকের ব্যাংক হিসাব নেই। নিত্যদিনের চাহিদা মেটাতে তাঁদের নগদ অর্থের ওপর নির্ভর করতে হয়।

বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক। এর মানে হচ্ছে, তাঁরা নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে এসেছে কাজের প্রয়োজনে।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধে ভারত পুরো দেশ লকডাউন করেছে। ছবি: এএফপি
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধে ভারত পুরো দেশ লকডাউন করেছে। ছবি: এএফপি

উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব বলেছেন, এখানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। তিনি স্বীকার করেন, কোনো সরকার এর আগে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। তিনি বলেন, সব সরকারকে বিদ্যুতের গতিতে কাজ করতে হবে। কারণ, পরিস্থিতি প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে। এলাকাভিত্তিক বড় রান্নাঘর করতে হবে। রান্না করা খাবার লোকজনকে সরবরাহ করতে হবে। হাতে নগদ অর্থ বা চাল, আটা তুলে দিতে হবে। কে কোন রাজ্য থেকে এসেছে, সেসব বাছবিচার করা যাবে না।

অখিলেশ যাদব নিজের রাজ্য নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উত্তর প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য। সেখানে ২২ কোটি লোকের বাস।

উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেন, তাঁর কর্মীদের একটি দল অন্য রাজ্য থেকে আসা লোকজনকে শনাক্ত করছে। যাদের সাহায্য প্রয়োজন, তাদের সবাইকে সাহায্য করবে সরকার।

কৃষ্ণ লাল নামে রিকশাচালক জানান, চার দিন ধরে তাঁর কোনো আয় নেই। তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের খাওয়ানোর জন্য আমার অর্থ দরকার। শুনেছি, সরকার আমাদের অর্থ দেবে। কিন্তু সেই অর্থ কখন, কীভাবে নিতে হবে, তা জানা নেই আমার।’

কৃষ্ণ লালের বন্ধু একটি দোকানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি জানালেন, খাবার কেনার মতো অর্থ নেই তাঁর কাছে। তিনি বলেন, ‘দুদিন ধরে দোকান বন্ধ। আমাকে কোনো অর্থও দেওয়া হয়নি। আমি জানি না দোকান কবে খুলবে। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমার পরিবার আছে। কীভাবে আমি তাদের খাওয়াব?’

খেটে খাওয়া মানুষদের অনেকেই জানেন না করোনাভাইরাস কী, কেন পুরো দেশ অবরুদ্ধ, কেন মানুষের যাতায়াত বন্ধ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, তিনি কয়েক বছর ধরে এলাহাবাদ স্টেশনে জুতা পলিশ করেন। কিন্তু এখন স্টেশনে কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। কেন লোকজন স্টেশনে আসছে না, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। কিছুদিন ধরে লোকজন স্টেশনে আসছে না। শুনেছি, কারফিউয়ের মতো কিছু চলছে। কিন্তু কেন?’

কথোপকথনের সময় বিনোদ প্রজাপতি নামের এক ব্যক্তি যেচে এসে কথা বলা শুরু করেন। তিনি জানান, স্টেশন এলাকায় তিনি পানির বোতল বিক্রি করেন। বললেন, ‘আমি করোনাভাইরাসের ব্যাপারে সব জানি। পুরো বিশ্ব লড়ছে। যাদের থাকার জায়গা রয়েছে এবং সামর্থ্য রয়েছে, তারা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের মতো মানুষের জন্য নিরাপত্তা ও ক্ষুধার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। আমাদের কোনটা বেছে নেওয়া উচিত?’