চীনে ১০ জনের ৯ জনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৯৭ বছর বয়সী এক নারী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এই ঘটনা গত বৃহস্পতিবার ফলাও করে প্রচার হয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যমে। এর আগের দিন বুধবার ইতালিতে ৯৫ বছর বয়সী নারীর সুস্থ হওয়ার খবরও জেনেছে বিশ্ব।

করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে বয়স্কদের—তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণা এখন পর্যন্ত তা–ই বলছে। সেই তুলনায় যাঁরা তরুণ তাঁরা দ্রুত সেরে উঠছেন। কারণ, তাঁদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সবল।

বিশ্বে এ পর্যন্ত যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ সেরে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ সেরে উঠেছে চীনে, ৯২ শতাংশ। এরপর আছে দক্ষিণ কোরিয়া, ৪৯ শতাংশ। ইরানেও প্রায় এক–তৃতীয়াংশ মানুষ সেরে উঠেছে। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স,  যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সেই তুলনায় সুস্থ হওয়া মানুষের হার খুবই কম। বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে সুস্থতার হার সবচেয়ে কম যুক্তরাষ্ট্রে, ২ শতাংশের কিছুটা বেশি।

চীন ইতিমধ্যে বৈশ্বিক এই মহামারি প্রায় কাটিয়ে উঠেছে এবং দক্ষিণ কোরিয়া মোটামুটি সামলে নিয়েছে। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারলে সেখানে সুস্থ হওয়া মানুষের হারও দ্রুত বাড়বে বলে আশা করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার সার্বক্ষণিক বৈশ্বিক পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৩৭ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ২৪ হাজার ৯০৬ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৪ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬৭ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব রাখছে ওয়ার্ল্ডওমিটারস ডটইনফো। তাদের হিসাবে, বর্তমানে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশের সংক্রমণ মৃদু। বাকি প্রায় ৫ শতাংশ রোগীর অবস্থা বেশ জটিল বা গুরুতর।

তবে আক্রান্তদের মধ্যে কাদের সুস্থ বলা হবে, তা নিয়েও ভিন্নমত আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের সংক্রমণ মৃদু তারা কিছু দিন ভোগার পর পরীক্ষায় ফলাফল নেতিবাচক আসছে এবং তারা সুস্থ বোধ করছে। তখন তাদের সুস্থ হিসেবে হিসাব করা হচ্ছে। আর গুরুতর অবস্থায় পৌঁছে গিয়েও চিকিৎসায় সেরে উঠছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের ভুগতে হতে পারে। এর মধ্যে যাদের আবার আগের অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ ছিল; তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। জীবন রক্ষা পেলেও তাদের ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ, সুস্থতার সময়, মৃত্যুর হার—কোনো কিছু নিয়েই চূড়ান্তভাবে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কেননা, তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণায় প্রতিদিনই নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে।

জার্মানির বার্লিন ও মিউনিখের চার বিশেষজ্ঞের গবেষণা অনুযায়ী, যাদের সংক্রমণ মৃদু তারা অসুস্থ বোধ করার পর থেকে মোটামুটি ১০ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছে। চীনের উহানের চার চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ বলছে, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথা বা কাশির মতো উপসর্গগুলো বিদায় নেওয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ভাইরাস থাকতে পারে।

করোনাভাইরাস আক্রান্তদের শরীরে কত দিন ভাইরাসটি থাকতে পারে, তা গত সপ্তাহে বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, চীনে আক্রান্ত এক ব্যক্তির শরীরে ৩৭ দিন পর্যন্ত ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষকরা গেছে।

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া পরিস্থিতি সামলে নিচ্ছে

চীনে এক দিনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৪ হাজার ১০৮ জন। এর ছয় দিনের মাথায় ১৮ ফেব্রুয়ারি নতুন করে আক্রান্ত হওয়া ও সুস্থ হওয়ার হার মোটামুটি সমান হয়ে আসে। ওই দিন আক্রান্ত হয় ১ হাজার ৭৪৯ জন। আর সুস্থ হয় ১ হাজার ৮২৪ জন। এরপর থেকে প্রতিদিন যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার থেকে বেশি মানুষ সুস্থ হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৮১ হাজার ৩৪০ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে ৭৪ হাজার ৫৮৮ জন। অর্থাৎ ৯১ দশমিক ৬৯ শতাংশ মানুষই সুস্থ হয়েছে।

>

জোরালো পদক্ষেপের কারণেই চীনে সাফল্য
বিশ্বে এ পর্যন্ত যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ সেরে উঠেছে

চীনের সাফল্যের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে প্রথম থেকেই তারা যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নেয়। পুরো শহর ও প্রদেশকে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে লোকজনকে কঠোরভাবে বাধ্য করানোর ফল পেয়েছে চীন। রোগ শনাক্তকরণে দ্রুত পদক্ষেপও নিয়েছে চীন। তবে চীনে সুস্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় আক্রান্ত হয়েছিল কিছু মানুষ।

এখন পর্যন্ত যে কয়টি দেশ চীনের মতো সফলভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে যেমন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত কমে এসেছে, তেমনি সুস্থ হওয়ার হারও বেশি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ৩৩২ জন। এর মধ্যে মারা গেছে মাত্র ১৩৯ জন। সুস্থ হয়েছে ৪ হাজার ৫২৮ জন। অর্থাৎ ৪৮ দশমিক ৫২ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। দেশটিতে গত ১০ মার্চ থেকে প্রতিদিন যত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছে।

মৃত্যুহার বেশি ইতালি ও স্পেনে, জার্মানিতে কম

ইতালিতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৩১ জানুয়ারি। এরপর চলতি মাসের ১০ তারিখ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৮০ হাজার ৫৮৯ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ২১৫ জনের। আর সুস্থ হয়েছে ১০ হাজার ৩৬১ জন। সুস্থতার হার ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ১০ দিন ধরে দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছে ৪ থেকে ৬ হাজার মানুষ। সেই তুলনায় এই সময় প্রতিদিন সুস্থ হচ্ছে গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ২০৩ জন। একই দিন সুস্থ হয় মাত্র ৯৯৯ জন।

ইতালিতে মৃত্যুহার বেশি এবং সুস্থতার হার কম হওয়ার একটা কারণ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা। তাদের তথ্যমতে, ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের বাস ইতালিতে। দেশটির জনসংখ্যার ২৩ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারিবিজ্ঞান–বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক আবরি গর্ডন বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা সুবিধাসহ অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বয়সও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তুলনামূলকভাবে গড় বয়স বেশি—এমন দেশে মৃত্যুহার বেশি হবে—মহামারির ক্ষেত্রে সাধারণত এটাই দেখা যায়।

ইতালির মতো স্পেনেও প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৩১ জানুয়ারি। তবে পুরো ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণের হার ছিল বেশ কম। এরপর থেকে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। তবে সপ্তাহখানেকের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে স্পেনে। কিন্তু সেই তুলনায় সুস্থতার হার খুবই কম। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্ত ৫৭ হাজার ৭৮৬। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ১৫। মারা গেছে ৪ হাজার ৩৬৫ জন। অর্থাৎ এখন রোগী আছে ৪৬ হাজার ৪০৬ জন। সুস্থতার হার ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ।

জার্মানিতেও সুস্থতার হার প্রতিবেশী ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় কম। দেশটিতে আক্রান্ত প্রায় ৪৭ হাজার ২৭৮ জন। মারা গেছে মাত্র ২৮১ জন। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে সুস্থ হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৬৭৩ জন (প্রায় ১২ শতাংশ)।

বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান রাইনহার্ড বুসে বলেন, ‘সংক্রমণের শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করা ও আইসোলেশন করা খুবই জরুরি। জার্মানি এটা করতে পেরেছে। এ কারণে মৃত্যুর হার সামাল দেওয়া গেছে।’

আক্রান্তের সংখ্যায় সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৬ মার্চ দেশটিতে মোট আক্রান্ত ছিল মাত্র ৪ হাজার ৪৩৪ জন। ১০ দিনের মধ্যে ২৬ মার্চ এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৫৯৪ জনে। এর মধ্যে মারা গেছে ১ হাজার ৩০০ জন। কিন্তু সুস্থ হওয়ার হার খুবই কম, মাত্র ২ দশমিক ১৮ শতাংশ।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ রাইনা ম্যাকলিন্টায়ার বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়েছে, মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশি বেশি পরীক্ষা করে দ্রুত রোগ শনাক্ত কর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি কোথা থেকে সংক্রমিত হলো, সেটা জানাও জরুরি। এতে করে সেসব লোকজনকেও আইসোলেশন করা সম্ভব হয়।