কত দুর্যোগ, ইতিহাসের কত বাঁক বদলের সাক্ষী তিনি

১১২ বছর বয়সী বব ওয়েইটন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষ। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে
১১২ বছর বয়সী বব ওয়েইটন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষ। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে

গত এক শ বছরে পৃথিবী কতটা বদলেছে? কতটা বদলেছে মানুষের জীবন? এর উত্তর খুঁজতে পৃথিবীর ইতিহাস বিষয়ক হাজার হাজার নথি ওলটানোই দস্তুর। কিন্তু সেই খটমটে ইতিহাসপাঠ কজনেরই-বা ভালো লাগে। সেখান থেকে বাদ পড়ে যায় ব্যক্তির অভিজ্ঞতাও। তবে এই ইতিহাস পাঠ যদি হয়, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে তার অভিজ্ঞতা শোনার মধ্য দিয়ে, তবে তা নিশ্চিতভাবেই অনেক সরস হয়ে ওঠে। সেখানে পাওয়া যায় ইতিহাসের বাঁকবদলের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের সংযোগের আখ্যানটিও।

ইতিহাসের এমন পাঠ দিতে এই মুহূর্তে বব ওয়েইটনের চেয়ে যোগ্য আর কে আছেন? আজ ২৯ মার্চ তাঁর জন্মদিন। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই কালে তিনি তো ঘরবন্দী হয়ে আছেন। তাই পালন করা হয়নি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক এই মানুষটির জন্মদিন। আলাপের সুযোগ যখন নেই, তখন তাঁর সময়ের কিছু ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। তাঁর সঙ্গী হওয়া এই নিদাঘের কালে আমাদের নিজেদের জন্যও দরকার। কারণ, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, একাধিক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মহামারি দেখেছেন তিনি। এসব প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের বিরুদ্ধে অবিনাশী জীবনীশক্তির এক জলজ্যান্ত স্বাক্ষর তিনি।

বব ওয়েইটনের জন্মদিনে বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আজ ১১২ বছরে পা দেওয়া বব এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। ১৯০৮ সালে যখন তাঁর জন্ম, ঠিক সে বছরই জন্ম হয় বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ইন্টার মিলানের। একই বছরে দ্বার উন্মোচন হয়েছিল ভিঅ্যান্ডএ জাদুঘরের। বব ওয়েইটন পৃথিবীর আলো দেখার পর দু বছর বেঁচেছিলেন ব্রিটিশ রাজা সপ্তম অ্যাডওয়ার্ড।

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সারা বিশ্বই এক রকম স্থবির হয়ে পড়েছে। এই স্থবিরতায় আক্রান্ত বব ওয়েইটনও। বর্তমানে হ্যাম্পশায়ারের অ্যাল্টনে নিজ বাড়িতে সতর্কতা হিসেবে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে আছেন তিনি।

ঘণ্টায় ২০০ মাইলের গতি পেরিয়ে নতুন রেকর্ড করেছিলেন হেনরি সেগ্রেভ। ছবি: উইকিমিডিয়া মনসের সৌজন্যে
ঘণ্টায় ২০০ মাইলের গতি পেরিয়ে নতুন রেকর্ড করেছিলেন হেনরি সেগ্রেভ। ছবি: উইকিমিডিয়া মনসের সৌজন্যে

১৯০৮ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ছেলেদের নামের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল উইলিয়াম, জন ও জর্জ। জনপ্রিয় নামের তালিকায় রবার্ট নামটি ছিল ১৫তম অবস্থানে। আর মেয়েদের নামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ম্যারি, এলিজাবেথ, ফ্লোরেন্স ও অ্যানি। মজার বিষয় হলো, একই বছর জন্ম নেওয়া এবং এখনো জীবিত নারী জোয়ান হকওয়ার্ডের নামও সে সময়ের জনপ্রিয় নামের তালিকায় অনেক পেছনে ছিল।

বব ওয়েইটনের যখন চার বছর বয়স, তখন মারা যান ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক এক্সপেডিশনের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফ্যালকন স্কট। স্কট ও তাঁর দল দক্ষিণ মেরু অভিমুখে অভিযান চালিয়েছিলেন। লক্ষ্যে পৌঁছে অবশ্য তাঁরা জানতে পারেন, নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড অ্যামান্ডসেন আগেই সে লক্ষ্য জয় করেছেন। সেটা ছিল ১৯১২ সালের ১৭ জানুয়ারি। স্কটসহ তাঁর দলের সব সদস্য সে যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পারেননি। খাবার ফুরিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ঝড়সহ বিরূপ প্রকৃতি। ওই বছরের ২৯ মার্চ স্কট তাঁর শেষ চিঠিতে লেখেন, ‘খুবই বাজে পরিস্থিতি। মনে হয় না, আর লিখতে পারব।’ এরও আট মাস পর তাঁদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

বব ওয়েইটনের দশম জন্মদিনটি ছিল ব্রিটেনের জন্যই এক দুর্যোগের কাল। ওই বছর অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যাটল অব আম্মানে রীতিমতো ধুঁকতে হয় ব্রিটিশ বাহিনীকে। বৈরী আবহাওয়াসহ নানা কারণেই সেই যুদ্ধে পিছু হটতে হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীকে।

১৯২৭ সালের ২৯ মার্চ। বব ওয়েইটনের বয়স তখন ১৯ বছর। বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা বর্তমানের মতো থাকলে বব হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ডেটন সৈকতের দিকেই চোখ রাখতেন। সে সময় সানবিম ১০০০ অর্শ্বক্ষমতাসম্পন্ন (এইচপি) বিশেষ ইঞ্জিন তৈরি করছে। প্রকৌশলী হেনরি সেগ্রেভ ধরণিতে গতির ঝড় তুলতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পেরেছিলেনও। ঘণ্টায় ২০০ মাইল গতিবেগের রেকর্ড ভাঙতে পেরেছিল তাঁর তৈরি ইঞ্জিন। তবে এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য দুটি সফল রাইডের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রথমটিতেই বিপাকে পড়েন সেগ্রেভ। প্রবল বাতাসের কারণে তাঁর গাড়িটি পথে পিছলে যাচ্ছিল। শেষে গতিনিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁকে গাড়িটি সাগরে নামিয়ে দিতে হয়। তবে ফিরতি রাইড শেষ হয় কোনো বিপত্তি ছাড়াই। দুই রাইড মিলিয়ে তাঁর তৈরি ইঞ্জিনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২০৩ দশমিক ৭৯২ মাইল। সেই গাড়িটিই ৯০ বছর পর হ্যাম্পশায়ারের ন্যাশনাল মোটর মিউজিয়ামে প্রদর্শন করা হয়; ববের বয়স তখন ১০৯ বছর।

বব ওয়েইটনের বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন জন্মেছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। ছবি: রয়টার্স
বব ওয়েইটনের বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন জন্মেছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। ছবি: রয়টার্স

আরও এগিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৩৮ সালের ২৯ মার্চ। বব ওয়েইটনের বয়স ৩০ হলো। ব্রিটেনসহ গোটা দুনিয়া যুদ্ধের দামামা শুনছে। ঠিক সেই সময় ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে চলছে তুমুল বিতর্ক। বিষয়—রাবারের জুতা। ২৫ লাখ রাবারের জুতা আমদানি করা হয়েছে ব্রিটেনে। হাউস অব কমনসের সদস্যরা এসব জুতার বাজারে থাকা-না থাকা নিয়ে তর্কে লিপ্ত। মূল বিবেচ্য বিষয়, এ জুতাগুলো যুক্তরাজ্যের জুতা উৎপাদকদের ব্যবসায় ধস নামাবে কিনা। ব্রিটিশ বাজারের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সহযোগিতার কথা বলছেন বোর্ড অব ট্রেডের প্রেসিডেন্ট। এতেই ওঠে ব্যাপক বিতর্ক। এমপি জে জে ডেভিডসন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘বিদেশি হিলকে (জুতার হিল) তবে বোর্ড অব ট্রেড কোনো সমর্থন দেবে না?’ এ বক্তব্য সে সময় খুব হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিল।

১৯৪৩ সাল। জন্ম নিলেন জন মেজর, যিনি হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। বব ওয়েইটনের বয়স তখন ৩৫ বছর। বিশ্বযুদ্ধের সে সময় ববের কেমন কেটেছে, তা আমাদের ইতিহাসের বইপত্রই জানাতে পারে। ১৯৫৫ সালে ৪৭ বছর বয়সী বব সাক্ষী হলেন আরেকটি বিশ্ব রেকর্ডের। ওই বছর ফ্রান্সের এসএনসিএফ সে সময়ের সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চালনার রেকর্ড করে। ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২০৬ মাইল বা ৩৩১ কিলোমিটার।

তারপর এল সেই ষাটের দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উন্মাতাল সময়। সারা বিশ্বে চলছে পরিবর্তনের ঢেউ। সংগীত থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে এক ধরনের নতুন জাগরণ। সেই ষাটের দশকের শেষ ১৯৬৯ সাল। বব ওয়েইটনের বয়স তখন ৬১ বছর। তাঁর জন্মদিনের দিনই ছিল ইউরোভিশন সং কনটেস্টের সমাপনী দিন। ওই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাজ্য, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স যৌথভাবে শীর্ষে অবস্থান নেয়।

১৯৭৪ সালের ২৯ মার্চ, বব পালন করলেন তাঁর ৬৬তম জন্মদিন। ওই একই দিনে চীনের জিয়ানে এক দল কৃষক মাটির তলায় খুঁজে পেলেন মাটির তৈরি একটি মানুষের মাথা, যা দেখতে অবিকল মানুষের আসল মাথাটার মতোই। আবিষ্কৃত হলো ২ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো বিখ্যাত টেরাকোটা আর্মি। তিনটি স্থান খনন করে পাওয়া যায় মোট ৮ হাজার টেরাকোটার সেনা, ১৩০টি রথ ও ৫২০টি ঘোড়া। ধারণা করা হয়, চীনের প্রথম সম্রাট কিন শিহুয়াংদিকে মৃত্যুর পর সহায়তার উদ্দেশ্যেই এ বিরাট বাহিনীটি তৈরি করা হয়েছিল।

সাবেক ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকি স্মিথ অদ্ভূত দাবি তুলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। ছবি: রয়টার্স
সাবেক ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকি স্মিথ অদ্ভূত দাবি তুলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। ছবি: রয়টার্স

১৯৯০ সাল। গোটা বিশ্বের জন্য অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছর ববের বয়স হলো ৮২। যেদিন বব ৮২ বছরে পা দিলেন, সেদিনই শুরু হলো হাইফেন ওয়ার। কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর চেকোস্লোভাকিয়াকে কী নামে ডাকা হবে, তা নিয়ে সৃষ্ট বিতণ্ডা থেকেই সেই ছোট যুদ্ধের জন্ম। এখন শুনতে যতই হাস্যকর লাগুক, ‘চেকোস্লোভাক’ রিপাবলিক ডাকা হবে নাকি ‘চেকো-স্লোভাক’ রিপাবলিক ডাকা হবে—তাই ছিল তর্কের কেন্দ্রে। স্লোভাকরা মনে করেছিল, প্রথম নামে চেকদের সঙ্গে স্লোভাকদের সমতা ঠিক দৃশ্যমান নয়। কোনো মীমাংসা হয়নি। শেষে ১৯৯৩ সালে আলাদা দুটি দেশের জন্ম হয়; চেক রিপাবলিক ও স্লোভাক রিপাবলিক।

বব ওয়েইটনের ১০১তম জন্মদিনটি মনে রাখার কথা। ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ এক অদ্ভুত কারণে গোটা বিশ্বের নজর কাড়েন যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকি স্মিথ। তিনি পর্নোগ্রাফিক সিনেমার ফি পরিশোধের দাবি করেছিলেন পার্লামেন্টের কাছে। এ নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কের মুখে অবশ্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পরের বছরই তাঁকে নিজের আসনটিও হারাতে হয়। তার পরের বছর ২০১১ সালে তিনি পর্নোগ্রাফির ওপর একটি রেডিও ডকুমেন্টারির সঞ্চালনা শুরু করেন।

২০১৪ সালে বব ওয়েইটনের ১০৬তম জন্মদিনে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের প্রথম সমলিঙ্গের বিয়েটি হয়েছিল। উত্তর লন্ডনের বাসিন্দা ম্যাকগ্রেইথ ও ডেভিড ক্যাব্রেজা বিয়ে করেছিলেন ওই দিন।

আর এখন ২০২০ সাল। বিশ্ব যাচ্ছে এক ভয়াবহ মহামারির মধ্য দিয়ে। চারদিকে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন শব্দ ছাড়া কিছু নেই। এবারের জন্মদিনটি অবশ্য আরেকটি কারণেও বিশেষ। কারণ এবারই একা কোনো আয়োজন ছাড়াই বিশেষ এ দিনটি পার করছেন তিনি। ১১২ বছর বয়সী বব ওয়েইটন এখন পর্যন্ত পাঁচজন ব্রিটিশ রাজ, ২২ জন প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন। হাউস অব কমনসে নির্বাচিতদের আসা-যাওয়ার সাক্ষী হয়েছেন। এই সময়ে আমেরিকা প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়েছে ২১ জনকে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, স্প্যানিশ ফ্লু—যার কথা এখন খুব শোনা যাচ্ছে, কলেরা বা গুটিবসন্তের কারণে সৃষ্ট মহামারি, অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধের সময়ে বেঁচেছিলেন এবং আছেন। আগামী বছরও হয়তো বেঁচে থাকবেন, তারপরও হয়তো—সবার চাওয়া তেমনই। বব ওয়েইটন এই মহামারি আতঙ্কে থাকা বিশ্বে এক দারুণ আশার প্রদীপ।