করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে (শেষ পর্ব)

হংকং ডিজনিল্যান্ডের মতো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্যানগুলো এই সময়ে ফাঁকা হয়ে পড়লেও সংকটের পর তা মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স
হংকং ডিজনিল্যান্ডের মতো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্যানগুলো এই সময়ে ফাঁকা হয়ে পড়লেও সংকটের পর তা মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স

সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনাভাইরাস। আক্রান্তের তালিকায় কোন দেশ নেই, তা খুঁজতে এখন রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হবে। মহামারি ঠেকাতে নানা উদ্যোগ চলছে। একই সঙ্গে চলছে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বের রূপটি কেমন হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা। এ নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে, তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, ভালো বা মন্দ যেমনই হোক, এই সংকট অভাবনীয়ভাবে বদলে দেবে সামাজিক বিন্যাস।

মার্কিন পত্রিকা ‘পলিটিকো’ গত সপ্তাহে বৈশ্বিকভাবে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটের প্রেক্ষাপটে ৩০ জনের বেশি বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদের মতামত নিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট এই ব্যক্তিরা সমাজের ওপর চলমান এ সংকটের বহুমুখী প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন, যা আদতে বার্তার চেয়েও বেশি কিছু।

সোনিয়া শাহ। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে
সোনিয়া শাহ। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে

ভোগের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ
সোনিয়া শাহ, ‘প্যান্ডেমিক: ট্র্যাকিং কন্টাজিয়নস ফ্রম কলেরা টু ইবোলা অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইয়ের লেখক। তাঁর লেখা ‘দ্য নেক্সট গ্রেট মাইগ্রেশন: দ্য বিউটি অ্যান্ড টেরর অব লাইফ অন দ্য মুভ’ নামের আরেকটি বই বর্তমানে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

সবচেয়ে ভালো যা হতে পারে, তা হলো বৈশ্বিক মহামারির আতঙ্ক সমাজকে বাধ্য করবে ভোগের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টিকে মেনে নিতে। ভবিষ্যৎ সংক্রামক রোগ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষার স্বার্থেই যৌক্তিক মূল্য হিসেবে তাকে এটি মেনে নিতে হবে। দশকের পর দশক ধরে আমরা আমাদের সীমাহীন ক্ষুধাকে পরিতৃপ্ত করতে পৃথিবীর বুকে শিল্প-স্থাপনার অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণ ঘটিয়েছি। বন্য প্রাণীদের বাধ্য করেছি নিজেদের গুটিয়ে নিতে। এই সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে বন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের সংযোগ বেড়েছে। আর এভাবেই সার্স-কোভ-২, ইবোলা, জিকার মতো বন্য প্রাণীর দেহে থাকা শত শত অণুজীব মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে, যারা মহামারির কারণ হয়ে উঠছে।

তত্ত্বীয়ভাবে বলা যায়, আমরা পারতাম আমাদের শিল্পায়নের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে, যাতে প্রাণিদেহের অণুজীব প্রাণীর দেহেই থাকে। সে ক্ষেত্রে এমন সংক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা কম থাকত। এই পরিস্থিতিতে এখন বৈশ্বিকভাবেই নীতি প্রণয়ন-সম্পর্কিত বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসবে মানুষের মূল আয় ও অসুস্থতাজনিত সবেতন ছুটির প্রসঙ্গটি। গণহারে বিচ্ছিন্ন থাকার অবধারিত ফল হিসেবে সামনে চলে আসবে মানুষে-মানুষে সংসর্গের উচ্চ চাহিদা এবং ছোট পরিসরে হলেও উচ্চ জন্মহারের মতো বিষয়। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের যে উল্লম্ফন এ সময়ে হচ্ছে, তাতে বর্তমানে নিঃসঙ্গ থাকতে বাধ্য হওয়া তরুণ প্রজন্ম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের প্রতি আস্থা রেখে সাংস্কৃতিক বদল নিয়ে আসবে।

টড এন টাকার। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে
টড এন টাকার। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে

অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে
টড এন টাকার, রুজভেল্ট ইনস্টিটিউটের গভর্ন্যান্স স্টাডিজের পরিচালক

২০১৮ সালের সেই পুরোনো দিনে জাতীয় নিরাপত্তার বৈশ্বিক মানদণ্ডের দোহাই দিয়ে স্টিলের ওপর শুল্ক আরোপ করায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সে সময় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটার পোস্টে লিখেছিলেন, ‘যদি তোমার স্টিল না থাকে, তবে তোমার কোনো দেশও থাকবে না।’ তবে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই ধাতুর বাজারকে অস্থির করে তোলার (মার্কিন এই পদক্ষেপের) কারণ হিসেবে চীনকে চিহ্নিত করেছিলেন। একই সঙ্গে তাঁরা মনে করেছিলেন, মার্কিন মিত্রদের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ ছিল অত্যন্ত বাজে সিদ্ধান্ত। এও বলা হয়, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সব স্টিল শিল্প হারিয়ে বসে, তবে আমরা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে এর সরবরাহ পাব।

এবার ২০২০ সালে আসা যাক। এই সপ্তাহেই মার্কিন মিত্ররা বন্দর ও রপ্তানি বন্ধসহ সীমান্তে বাড়তি বিধিনিষেধ আরোপের কথা ভাবছে বলে জানা গেছে। যদিও বাণিজ্যের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়—এমন কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে যে কারও মাথায় এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের পূর্বাভাসই আসবে, যেখানে ভয়াবহ মন্দার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও। আর এগুলো স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশযোগ্যতা কমাবে। একই সঙ্গে বহু পণ্য অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন করার ক্ষমতা না থাকায় যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্তে তার সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাও ব্যাপকভাবে কমবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত সঠিক পদক্ষেপ ছিল কি না, তা নিয়ে যৌক্তিক তর্ক চলতেই পারে। তবে সামনের বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে রক্ষণশীল যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রতি ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান নির্বিশেষে বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিকদের সমর্থন মিলবে, যাতে মিত্র দেশগুলোর দিক থেকে বাণিজ্য খাতে যেকোনো সিদ্ধান্তেও স্থিতিশীল থাকা যায়। সাম্প্রতিক অতীতকে বিবেচনায় নিলে এটি হবে অনেক সংহত পুনর্গঠন।

দাম্বিসা ময়ো। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে
দাম্বিসা ময়ো। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে

ব্যয় বাড়বে ভোক্তা ও করপোরেশন উভয়েরই
দাম্বিসা ময়ো, অর্থনীতিবিদ ও লেখক

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি করপোরেশনগুলোর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে, যাতে তারা বিদ্যমান বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার কার্যকারিতার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা খণ্ডিত সরবরাহ ব্যবস্থার বদলে আরও বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নতুন এই ব্যবস্থায় মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পেলেও এই রূপান্তর অবশ্য ভোক্তা ও করপোরেশন উভয়েরই ব্যয় বাড়াবে।

থেডা স্কোকপল। ছবি: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট
থেডা স্কোকপল। ছবি: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট

বৈষম্য বাড়বে
থেডা স্কোকপল, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক

যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য নিয়ে আলোচনা মাঝেমধ্যেই ১ শতাংশের সঙ্গে ৯৯ শতাংশের আয়ের ব্যবধানের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। কিন্তু সর্বোচ্চ আয় করা ৫ শতাংশ ও সবচেয়ে নিচুতলার মানুষের মধ্যবর্তী পর্যায়েও বৈষম্য বেড়েছে। এই সংকটে ওই বৈষম্য আরও বাড়বে।

সাম্প্রতিক দশকগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় তাঁদের নিচে অবস্থান করা শ্রেণির তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বিবাহিত ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি। উচ্চ বেতনের পেশাজীবী বা ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁরা এমন ঘরে বাস করেন, যেখানে রয়েছে ইন্টারনেট ও ফোনে যোগাযোগের সুযোগ থেকে শুরু করে সন্তানদের জন্য আলাদা ঘরসহ নানা ব্যবস্থা। ফলে তাঁদের পক্ষে ঘরে থেকে কাজ করাটা অনেক সহজ। এই সংকটকালে তাঁরা তাই আগের মতোই আয় করে যাবেন। আর তাঁদের নিত্যপণ্য তাঁদের দোরগোড়াতেই পৌঁছে যাবে।

বাকি ৮০ শতাংশ মার্কিনের এই আর্থিক সুযোগটি নেই। কেউ কেউ আগের মতোই থাকবেন। তবে অনেকেই কাজ হারিয়ে পরিবারের বোঝা হয়ে উঠবেন। একক আয়ে চলা পরিবারগুলোই এ বিপদে পড়বে বেশি। তাঁদের ঘরে থেকে কাজ করার সুযোগও কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা সেবা খাত বা পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। আর এ ধরনের চাকরি তাঁদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের সন্তানেরা ঘরে বসে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারবে না, যেহেতু তাদের মা-বাবার পক্ষে তাদের সহায়তা করা সম্ভব হবে না। এমনকি উচ্চগতির ইন্টারনেট না থাকায় অনেকের ক্ষেত্রেই দূর থেকে সন্তানদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়াও সম্ভব হবে না। ফলে সার্বিকভাবে বৈষম্য বাড়বে।

মেরি ফ্রান্সিস বেরি। ছবি: পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট
মেরি ফ্রান্সিস বেরি। ছবি: পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট

বৈচিত্র্যের ক্ষুধা
মেরি ফ্রান্সিস, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার আমেরিকান সোশ্যাল থট, হিস্ট্রি অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক

করোনাভাইরাস যে পৃথিবীকে স্থায়ীভাবে বদলে দেবে, তার কিছু নমুনা ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, যা হয়তো আরও বেগবান হবে। যেমন এখনই কোনো কোনো প্রবেশপথের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কণ্ঠস্বর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মহামারি পড়ানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা শুরু করেছেন মহামারির পূর্বাভাস, চিকিৎসা ও এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে বিস্তর গবেষণা। ইতিহাস অবশ্য আরেকটি বিষয়েও শিক্ষা নিতে বলছে।

১৯১৮-১৯ সালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলে ওঠার পর অধিকাংশ আমেরিকান একটু আয়েশি জীবন চেয়েছিল। ভয়-শঙ্কা পেরিয়ে জীবনে বিনোদন চেয়েছিল। এরই ফল হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও রেডিও আবিষ্কার অনেক সহজ হয়। সংবিধানের ১৯ সংশোধনীর মাধ্যমে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেন। এ ঘটনার পর ১০ বছরের মধ্যে অর্থনীতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। অযৌক্তিক বিনিয়োগ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বকে চাপে ফেলার আগ পর্যন্ত অর্থনীতির এই বিকাশ অব্যাহত ছিল।

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, করোনাভাইরাসের এই মহামারি শেষ হয়ে গেলে সম্ভবত মানুষ নানা দিক থেকে মুক্তি চাইবে। মানুষ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে।

পল ফ্রিডম্যান। ছবি: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট
পল ফ্রিডম্যান। ছবি: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট

রান্নায় ঝোঁক বেড়ে যাবে
পল ফ্রিডম্যান, ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ও ‘আমেরিকান কুইজিন: অ্যান্ড হাউ ইট গট দিস ওয়ে’ বইয়ের লেখক

গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, খাবার কেনা বা তৈরির চেয়ে আমেরিকানরা বাইরের প্রস্তুত খাবারের পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। তবে এই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষ একা একা সময় কাটাচ্ছে। এ কারণে বাধ্য হয়েই ঘরবন্দী মানুষ শিখছে—কী করে আগামী দিনগুলোতে বাইরে না গিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়। এ কারণেই একসময় তারা এই বাড়িতে রান্নার ব্যাপারে আবার অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। রেস্তোরাঁয় আর অযথা অর্থ খরচ করে সময় নষ্ট করতে চাইবে না। ইউরোপ ও আমেরিকার রেস্তোরাঁগুলোয় বসে খাওয়ার চল কমে যাবে। একই সঙ্গে বিশ্বের মানুষ কিছুদিনের জন্য হলেও অনেকটাই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে।

আলেক্সান্দ্রা লেঞ্জ। ছবি: সংগৃহীত
আলেক্সান্দ্রা লেঞ্জ। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দর ও মুখর হয়ে উঠবে উদ্যানগুলো
আলেক্সান্দ্রা লেঞ্জ, স্থাপত্য সমালোচক

আগে মানুষ পার্ক, ফুটবল মাঠ, বারবিকিউ বা একটু সুযোগ পেলেই খেলার মাঠের দিকে ছুটতেন। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এখন এসব প্রায় বন্ধ। ভাইরাসটি ছোঁয়াচে হওয়ায় এখন ঘরে বা বাসায় থাকাটাই জরুরি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, উদ্যানগুলো কম মূল্যবান হয়ে উঠেছে।

আমি বর্তমানে ব্রুকলিনে নিজের পরিবারের সঙ্গে আছি। আর প্রতিদিনই একবার বাইরে হাঁটতে বের হই। গোল্ডেন গেট পার্কের সংযোগ সড়কগুলো বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন লোককে আমি আহ্বান জানাতে দেখেছি, যাতে তারা হাঁটার জন্য আরও বড় পরিসর পায়। ব্রিটেনে ন্যাশনাল ট্রাস্ট এই সময়ে মানুষের জন্য আরও বেশি বাগান ও উদ্যান বিনা মূল্যে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছে। গত দশকে বড় শহরগুলো উদ্যান গড়ে তুলতে বড় বিনিয়োগ করেছে। এসব উদ্যান দূরত্ব মেনে অনেক মানুষের হাঁটাচলার জন্য উপযুক্ত।

শহুরে মানুষ খোলা জায়গা চায়। একটু হাঁটার পথ চায়। অনেক দিন এসব পার্ক ব্যবহৃত না হওয়ায় এক সময় সবুজে ভরে উঠবে। আর মানুষ তখন সবুজের সমারোহে মুক্ত বাতাসে আনন্দ উপভোগ করবে। আজকের এই সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য করা মহামারি শেষে মানুষ মানুষের অনেক কাছাকাছি আসতে চাইবে। সে সময় এই বড় পরিসরগুলো মানুষের কাছে অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে উঠবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষ্যেই নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ বাড়াতেই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

শপিংমল নিয়ে আমি একটি বই লিখছি। তবে সতর্কতার কারণে এখন শপিংমলে পর্যবেক্ষণে যাচ্ছি না। পার্কগুলোর যে কাজ, বর্তমান সময়ে শহরতলির শপিংমলগুলো একই কাজ করছে। সেখানেই মানুষ ভিড় জমিয়ে একত্র হচ্ছে, একে অপরের সঙ্গে দেখা করছে। ছোট্ট একটা জায়গার মাঝে এত মানুষের ভিড় করোনাভাইরাস ছড়ানোর উপযুক্ত জায়গা। তাই এই সময়ে শপিংমলগুলোতে ভিড় না জমানোই ভালো। এ ছাড়া অনেক দেশ জনগণের নিরাপত্তার কথা ভেবে শপিংমল বন্ধ ঘোষণা করেছে। ঘর ছাড়া মানুষের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এই মহামারি শেষ হয়ে গেলে আশা করব মানুষ আর শপিংমল নয়, বরং উন্মুক্ত মাঠ তৈরিতে বেশি বিনিয়োগ করবে। এতে মানুষ ও সবুজে মুখর হয়ে উঠবে সারা বিশ্বের উদ্যানগুলো।

ম্যাথিউ কন্টিনেত্তি। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে
ম্যাথিউ কন্টিনেত্তি। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে

‘পরিবর্তন’ ধারণার বদল ঘটবে
ম্যাথিউ কন্টিনেত্তি, আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের আবাসিক ফেলো

সাংবাদিকতায় বহুল ব্যবহৃত শব্দের একটি হচ্ছে ‘পরিবর্তন’। করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতেও এই শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকান সমাজ পরিবর্তনের একটি বিশেষ মডেলের সঙ্গে পরিচিত। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষত মুক্তবাজার, ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই এই শব্দের প্রয়োগ বেশি হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বদল আসবে এই ‘পরিবর্তন’ ধারণায়ও।

করোনাভাইরাস কেবল রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় আঘাত হানেনি। গৃহযুদ্ধ, মহামন্দা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই মুক্ত সমাজের ভিতে আঘাত করার ক্ষমতা এর রয়েছে। রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বহুমাত্রিক এই সংকট মোকাবিলায় নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, যার কোনো কোনোটি পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বৈশ্বিক অর্থনীতি এরই মধ্যে মন্দার প্রাথমিক স্তরে প্রবেশ করেছে, যা মহামন্দাতেও রূপ নিতে পারে। ইতিমধ্যে মার্কিন অর্থনীতির একটা বড় অংশ পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। মার্কিন নাগরিকেরা হালকা চালে চলার ও নিরবচ্ছিন্ন সক্রিয়তার রেওয়াজ থেকে মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফেডারেল সরকার এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা শুধু যুদ্ধকালেই দেখা যায়। ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত আমাদের সামগ্রিক চেতনা এরই মধ্যে বদলে গেছে। যদি করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা একই সঙ্গে ব্যক্তি স্বাস্থ্য ও গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আঘাত করে চলে, তাহলে আমাদের ‘পরিবর্তন’-এর আগের ধারণায় বদল আনতে বাধ্য হতে হবে। মূলগতভাবেই পরিবর্তন আসবে।

ভার্জিনিয়া হেফারনান। ছবি: লিংকডইনের সৌজন্যে
ভার্জিনিয়া হেফারনান। ছবি: লিংকডইনের সৌজন্যে

স্বভাবের স্বেচ্ছাচার আর নয়
ভার্জিনিয়া হেফারনান, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড লস: দ্য ইন্টারনেট অ্যাজ আর্ট’ বইয়ের লেখক

মানুষ তার প্রতিদিনের রুটিন বা চক্র থেকে সাধারণত একবারে বের হয়ে যেতে পারে না। তবে এই সময়ে কর্মক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার সর্বোচ্চ মাত্রা অর্জনের সাম্প্রতিক যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা অজস্র কুটিরশিল্পের পত্তন করেছে, তা আদতে নিকটজনকেই নায়কোচিত হিসেবে প্রদর্শনে ব্যস্ত ছিল। দ্য ফোর-আওয়ার ওয়ার্কউইক, দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট ও অ্যাটমিক হ্যাবিটসের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের পাঠকদের এমন স্বয়ংক্রিয় স্বভাব রপ্ত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, যার মূল কথাই হচ্ছে—বেশি কাজ ও কম খাওয়া।

তবে কোভিড-১৯-এর এই সময় জানাচ্ছে যে, আমাদের সময়ের নেতা হওয়ার যোগ্য তাঁরা নন। ‘দ্য প্লেগ’ বইয়ের লেখক আলবেয়ার ক্যামু মহামারিতে আলজেরিয়ার একটি শহর বিলোপ হয়ে যাওয়ার পেছনে নেতাদের কঠোরতাকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, মহামারিতে সেখানে সবাই বিরক্ত ছিল, সবাই তাদের পুরোনো অভ্যাস বদল করার চেষ্টা করছিল। আর শুধু অভ্যাসের পেছনে সময় ব্যয় করায় নগরবাসীর কল্পনাশক্তি হারিয়ে যাচ্ছিল। চারপাশের মৃত্যু দৃশ্য তাদের থমকে দিয়েছিল। এ কারণে তাদের রাস্তায় বেড়ানো, অর্থের প্রয়োজনে কাজ করা ও সিনেমা দেখার মতো কাজগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আলবেয়ার ক্যামুর সময়ের মতোই এটি আমাদের স্বৈরতন্ত্র ও মহামারির অপচ্ছায়া সম্পর্কে সতর্ক করছে, যা আমাদের নির্ধারিত আচরণবিধির বদলে কল্পনা, কাণ্ডজ্ঞান ও খামখেয়ালি স্বভাবের দিকে ফিরে তাকাতে বলছে। এই সময় আরও বেশি বিস্তৃত ও সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির দাবি করছে, যাতে আমরা ট্রাম্পের মতো গোঁড়া ও স্বেচ্ছাচারীর কবলে না পড়ি। একই সঙ্গে এটি পরিবেশবিধ্বংসী ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে—এমন কোনো আচরণের কবলেও যেন না পড়ি, তার বার্তাও দিচ্ছে। পৃথিবীতে আমাদের ক্ষণিকের আয়ুর কথা বিবেচনায় নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই মহামারি আমাদের মধ্যে আরও বিস্তৃত বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উদয় ঘটাতে পারে। ব্যবস্থাপত্র মেনে অভ্যাস গড়ার পাশাপাশি অর্থবহ ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের দিকে ঝোঁকার কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। (শেষ)

(অনুবাদ করেছেন: ফারুক হোসেন, শেখ সাবিহা আলম, নাজনীন আখতার, তপতী বর্মন, শুভা জিনিয়া চৌধুরী, ফজলুল কবির, সাইফুল ইসলাম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শাকিলা হক, রাজিউল হাসান ও অর্ণব সান্যাল।)

আরও পড়ুন: