করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে যা সবাইকে ভাবতে হবে

বিভিন্ন দেশের সর্বাধিক কার্যকর, নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ কৌশলে কোভিড-১৯–এর বিস্তার হয়তো কিছুটা কমে আসছে। তবে কোথা থেকে এই ভাইরাস এল মানুষের শরীরে এবং এখন কীভাবে যে এই রোগ সারবে, তা এখনো মানুষের অজানা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তারকে মহামারি ঘোষণা করার পর থেকে সবাই উন্মুখ হয়ে আছেন এটির কোনো ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আসবে এই আশায়। বিস্তার কমার পাশাপাশি মানুষ এখন উন্মুখ হয়ে আছে এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য। এই ভ্যাকসিন তৈরির নানা জটিলতার কথা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেছে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের অনলাইনে।

কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। এখনো তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের কর্মকর্তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এই ভাইরাসের জেনেটিক কোড প্রকাশ করেছেন। এর ফলে বিজ্ঞানীদের গবেষণা সহজ হয়েছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর আর্থিক সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে, দেশে এ নিয়ে চলছে গবেষণা। প্রায় ৩৫টি সংস্থা ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এর টিকা তৈরিতে কাজে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি সংস্থা বেশ অগ্রগতি দেখিয়েছে। তাদের তৈরি ভ্যাকসিন পশুর শরীরে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। এই চারটির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক বায়োটেক ফার্ম মডার্নার উৎপাদিত ভ্যাকসিন কিছুদিনের মধ্যে মানুষের শরীরে প্রথম ট্রায়াল শুরু করা হবে।

করোনাভাইরাস কিন্তু বিশ্বে নতুন নয়; এর আগেও এই ভাইরাসজনিত (অন্যরূপে) মহামারি দেখেছে বিশ্ব। ২০০২-০৪ সালে চীনে শুরু হওয়া সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়। সে সময় ২৬টি দেশের ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। শুধু চীনেই মারা যায় ৩৪৯ জন। হংকংয়ে মারা গিয়েছিল ২৯৯ জন। পরে ২০১২ সালে সৌদি আরবে মিডলইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোমে (মার্স) মারা যায় অনেক মানুষ। সব কটি ফ্লুর কারণই ছিল করোনাভাইরাস।

এবারের কোভিড-১৯ ভাইরাসটি যে প্যাথোজেন পরিবারের, তার নামও করোনাভাইরাস। সার্স ও মার্সের সময়ও ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু হয়। তবে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার পর সেগুলোর কাজ থেমে যায়। মেরিল্যান্ডভিত্তিক নোভাভক্স কোম্পানি এখন সার্স ভাইরাসের অসমাপ্ত ভ্যাকসিন নিয়ে সার্স-কোভ-২–এর জন্য নতুন করে কাজ করছে। এবং মানুষের শরীরে পরীক্ষার জন্য কাজও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে মডার্না কাজ করছে মার্স ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে।

সার্স-কোভ-২–এর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জেনেটিক উপাদান মেলে সার্সের সঙ্গে। দুটোই একটি গোলাকৃতির প্রোটিন ক্যাপসুলের ভেতরে রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ) নিয়ে গঠিত, যা স্পাইকগুলোকে আবৃত রাখে। এই স্পাইক মানুষের ফুসফুসের আস্তরণের কোষ পৃষ্টে রেসপিরেটরিতে আটকে থাকতে পারে। সার্স ও সার্স-কোভ-২ দুটি ক্ষেত্রেই ফুসফুসের ওপরের আস্তরণের কোষ ভেঙে ফেলতে থাকে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে একবার ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরে এটি কোষের রিপ্রোডাক্টিভ মেশিনারিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং নিজের অনুলিপি তৈরি করতে থাকে।

সব ভ্যাকসিনই একটি মৌলিক প্রিন্সিপাল নিয়ে কাজ করে। সাধারণত টিকার মাধ্যমে মানুষের ইমিউন সিস্টেমে জীবাণুটি জীবিত বা মৃত অবস্থায় (প্যাথোজেন) প্রবেশ করানো হয়। এই জীবাণুর রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকে না। ইমিউন সিস্টেমে প্যাথোজেনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। পরে অ্যান্টিবডি ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে দ্রুত কাজ শুরু করে। ভাইরাসটি দুর্বল হলে ইমুনাইজেশন হয়। তবে এই পদ্ধতিতে ঘাটতি আছে। কেউ কেউ কোভিড-১৯–এর ভ্যাকসিন তৈরিতে এই পরীক্ষিত পদ্ধতি ব্যবহার করছে। আবার কেউ কেউ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যেমন নোভাভক্স রিকম্বিন্যান্ট টিকা তৈরি করছে। এর মধ্যে আছে সার্স-কোভ-২–এর প্রোটিন স্পাইকের জিনগত কোড বের করা। যার মাধ্যমে ভাইরাসগুলোর একটি অংশ মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। আরেকটি পদ্ধতি হলো—প্রোটিনকে ডিঙিয়ে এবং জিনগত নির্দেশ থেকে নিজেই ভ্যাকসিন তৈরি করা। মডার্না এই কাজটিই করছে।

এর ধারাবাহিকতায় ইনোভিও অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। তারা বলছে, যদি মানুষের ওপর প্রাথমিক পরীক্ষা সফল হয়, তাহলে বৃহত্তর আকারে পরীক্ষা করা হবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ চীনে এর প্রয়োগ করা হতে পারে। তবে তখন পর্যন্ত এই ভাইসের সংক্রমণ কোনো অবস্থায় থাকবে, তা একটি আশঙ্কার বিষয়। ইনোভিও বলছে, তারা যে টাইমলাইন ধরে পরিকল্পনা করছে, যদি তারা এ ক্ষেত্রে সফল হয়, তাহলে তারাই হবে বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে একটি নতুন টিকা আবিষ্কারক। ইনোভিও ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় অর্থায়ন করছে কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সেপি)। এ ছাড়া এতে অর্থায়ন করেছে বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সারা বিশ্বের জনহিতৈষী বিভিন্ন সংগঠন।

কোনো ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অপরিহার্য। সাধারণত তিনটি পর্যায়ে এই ট্রায়াল করতে হয়। প্রথমে, কয়েক ডজন স্বাস্থ্যবান স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া হয়। ভ্যাকসিন প্রবেশ করিয়ে দেখা হয় কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে কি না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, কয়েক শ লোকের ওপর পরীক্ষা করা হয়, বিশেষ করে রোগে আক্রান্ত বিশ্বের একাংশের ওপর ভ্যাকসিনটি কতটা কার্যকর, তা দেখা হয়। শেষ পর্যায়ে, কয়েক হাজার লোকের ক্ষেত্রে একইভাবে পরীক্ষা করা হয়। তবে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন এই পর্যায় পার হতে হতে ক্ষতির আশঙ্কাও থাকে। যার ওপর পরীক্ষা করা হয়, তার ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তবে ত্রুটি খুঁজে বের করতে এই ট্রায়ালের বিকল্প নেই। আগে যদি এমন ভ্যাকসিনের অনুমোদ থাকে, তাহলে একই ধরনের ভ্যাকসিনের অনুমোদন পাওয়া সহজ হয়। যেমন অ্যানুয়াল ফ্লু ভ্যাকসিন। এটি বছরে বছরে কিছুটা আপডেট হয়। তবে সার্স-কোভ-২ যেহেতু মানুষে মানুষে হচ্ছে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই এটি পরীক্ষা করা সুবিধাজনক নয়। এ ছাড়া জেনেটিক উপাদান আরএনএ বা ডিএনএ থেকে কোনো ভ্যাকসিন আগে অনুমোদন পাইনি। তাই কোভিড-১৯–এর ভ্যাকসিন হবে একেবারে নতুন এক ভ্যাকসিন।

এর মধ্যে আরও একটি বিষয় হলো—যখন এই ভ্যাকসিন তৈরির অনুমোদন দেওয়া হবে এটি বিপুল পরিমাণে তৈরি করতে হবে। ভ্যাকসিন তৈরির পাল্লায় যেসব কোম্পানি আছে, তাদের বিপুল পরিমাণে এই ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা নেই। তা ছাড়া ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্যাকসিন তৈরি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ভ্যাকসিন উৎপাদনের যেসব সুবিধা আছে, তা নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন অনুসারে তৈরি হয়। এ ছাড়া যখন এর সফলতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকে, তখন তা বাণিজ্যিকীকরণ বেশ কঠিন। সেপিসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে। সেপি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি এবং উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ পরিকল্পনা করেছে। সামনের মাসের শুরুতে তারা ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ আহ্বান করবে।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়ে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে, তা হলো যাদের প্রয়োজন তাদের কাছে ভ্যাকসিনটি পৌঁছাচ্ছে কি না। এই চ্যালেঞ্জ কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নয়, বরং দেশে দেশে এই চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।