জাপানে ভুয়া তথ্যের খপ্পরে করোনাভাইরাস

টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকে ৩০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে লকডাউনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ছবি: এএফপি
টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকে ৩০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে লকডাউনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাকে কেন্দ্র করে বানোয়াট তথ্য ও বিশ্লেষণও অনেকটা করোনার মতোই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ফেসবুক ও টুইটার থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করা সহজ হয়ে যাওয়ায় ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতগতিতে। জাপানের মতো কঠোর নিয়মনীতি মেনে চলা দেশও বাদ যাচ্ছে না এই প্রবণতা থেকে।

জাপানে কয়েক দিন ধরেই এ রকম একটি গুজব বা ভুয়া তথ্য প্রচারিত হয়ে আসছিল যে মাস শেষ হওয়ার আগেই সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে যাচ্ছে এবং রাজধানী টোকিওর লকডাউনও সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এই গুজব আরও বেশি জোরালো হওয়ার আগে জাপান সরকারের প্রধান মুখপাত্র ৩০ মার্চ সকালে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সে রকম কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। এদিকে একই দিন রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকেও লকডাউনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। সারা রাত খোলা থাকা নাইট ক্লাব, বার ও এ রকম অন্যান্য বিনোদনের স্থান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কারাওকে বার ও মিউজিক ক্লাবে না যাওয়ার আহ্বানও তরুণদের প্রতি তিনি জানিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভুয়া খবর বা গুজবের ছড়াছড়ির বাইরে দৈনন্দিন আলোচনায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার মতো ভিত্তিহীন সংবাদের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেরও নজর এড়িয়ে যায়নি। ৩০ মার্চ ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাহী বোর্ডের বৈঠকে ১ এপ্রিল জরুরি অবস্থা জারির সম্ভাবনা নিয়ে প্রচারিত খবরকে তিনি সরাসরি ‘ফেক নিউজ’ আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দেন। তিনি উল্লেখ করেন, এ রকম খবরও প্রচারিত হচ্ছে যে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সামরিক আইন জারি করতে যাচ্ছে। জাপানের প্রচলিত আইনে সে রকম কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ধারণা একেবারেই অলীক।

এদিকে জাপানের রাজধানীতে টানা কয়েক দিন করোনাভাইরাসে সংক্রমণ হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ৩০ মার্চ প্রথমবারের মতো শনাক্ত হওয়া সংক্রমণের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া লক্ষ্য করা গেছে। ২৫ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত চিহ্নিত সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৪০-এর ওপরে, এরপর ২৮ ও ২৯ তারিখে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ ছাড়িয়ে যায়। তবে ৩০ মার্চ ১৩ জনের নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর দিয়েছে রাজধানীর কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে টোকিওতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৪৪৩।

ওষুধ আবিষ্কারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে জাপান
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. তেদরোস আধানোম গেব্রোয়াসুসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চলা সংলাপে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে হলে ওষুধ ও টিকা আবিষ্কার হবে গুরুত্বপূর্ণ। ফাভিপিরাভিরের ক্লিনিক্যাল গবেষণা এগিয়ে নিতে আগ্রহী অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগ দিতে জাপান আগ্রহী বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালানো গবেষণার বিষয়ে তথ্য পাওয়ার মধ্য দিয়ে ওষুধ আবিষ্কারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে যাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থন তিনি প্রত্যাশা করেন। জবাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, ওষুধ, টিকা ও রোগ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অন্যান্য বৈশ্বিক সংগঠনের সঙ্গে মিলে সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখবে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় টোকিওর একটি অ্যান্টিসেপটিক সলিউশনের দোকানের সামনে হাত ধোয়ার নিয়ম দেখানো হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় টোকিওর একটি অ্যান্টিসেপটিক সলিউশনের দোকানের সামনে হাত ধোয়ার নিয়ম দেখানো হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

জাপানের প্রধানমন্ত্রী দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর দেশগুলোকে সাহায্য করা এবং আন্তর্জাতিক সহায়তায় নেওয়া বৈশ্বিক পদক্ষেপে জাপানের নেতৃত্ব প্রদানের বিষয় উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের তহবিল বরাদ্দের উল্লেখ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, যেসব উন্নয়নশীল দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেসব দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা লাভে তহবিল কাজে লাগানো হবে।

জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে জাপানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সম্ভাবনা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়নি।

উদ্বিগ্ন ওকিনাওয়া
জাপানের দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ওকিনাওয়া এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকলেও জেলার একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবর প্রচারিত হয়েছে। এরপর উদ্বিগ্ন জেলা প্রশাসন এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদানের দাবি জানানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। ওকিনাওয়ার কাদেনা বিমানঘাঁটিতে দুজন বিমানসেনার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর ৩০ মার্চ প্রচারিত হয়। বিদেশ থেকে ফিরে আসা ওই দুই সেনাকে ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছে। এর বাইরে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

করোনার সংক্রমণ সেই দুজন থেকে ঘাঁটিতে কর্মরত বেসামরিক জাপানি নাগরিকদের মাধ্যমে জেলায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে ওকিনাওয়ার প্রশাসন এখন উদ্বিগ্ন। এ কারণে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক প্রশমনের জন্য সঠিক তথ্য দেওয়ার দাবি করেছে ওকিনাওয়ার জেলা সরকার।