করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্বই আপাতত সমাধান

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। গবেষকেরাও বলছেন, শুধু সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মানলেই করোনার সংক্রমণে অর্ধেক মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বীকৃত ওষুধ ও প্রতিষেধক এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। তাই রোগ শনাক্তকরণে পরীক্ষা জোরদার করতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার পাশাপাশি পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ ফুট বা ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম এড়ানো, গণপরিবহন ব্যবহার না করার মতো বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই আপাতত সমাধান।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের একদল গবেষক একটি গাণিতিক মডেল তৈরি করেছেন। গত সোমবার এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ইউরোপের ১১টি দেশে সংক্রমণের হার ও চিকিৎসাব্যবস্থা ছাড়া সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ আমলে নিয়ে মডেলটি দাঁড় করানো হয়েছে। এই দেশগুলো হলো ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া। প্রতিবেদনে ওই ১১ দেশে সামাজিক দূরত্বসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ না নেওয়া হলে কত মৃত্যু হতে পারত, তার একটি ধারণাগত হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।

গাণিতিক মডেলের ফলাফলে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকেরা মন্তব্য করেছেন, করোনা মহামারিতে চলতি বছর মারা যেতে পারে দুই কোটির মতো মানুষ। তবে সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুনগুলো মানা না হলে মৃত্যু চার কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদি আরও আগে কড়াকড়িভাবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যেত, তাহলে ৩ কোটি ৮৭ লাখ মৃত্যু এড়ানো যেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রতি জোর দিয়ে যাচ্ছে।

চীনের উহানে গত ৩১ ডিসেম্বর অজ্ঞাত কারণে মানুষের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত ৯ জানুয়ারি চীনের বিজ্ঞানীরা নতুন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করে জানান, এটি সার্স রোগ ছড়ানো সার্স–করোনাভাইরাসের গোত্রের। গত ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সংক্রমণকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। সংক্রমণ ঠেকাতে তত দিনে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। তারপরও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় গত ১১ মার্চ কোভিড–১৯ রোগের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বীকৃত ওষুধ ও প্রতিষেধক এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বীকৃত ওষুধ ও প্রতিষেধক এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তথ্যমতে, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১৭৮টি দেশে সংক্রমিত হয়েছে ৮ লাখ ১ হাজার ৪০০ জন। মারা গেছে ৩৮ হাজার ৭৪৩ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৭ জন।

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের কারণে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ওই ১১ দেশে করোনার সংক্রমণে ৫৯ হাজার মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সংক্রমণ ছড়ানোর হার একদম কমে আসা পর্যন্ত এসব পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে আরও অনেক মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে চীনের পদক্ষেপের উদাহরণ টানা হয়েছে। দেশটির হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গত ২৩ জানুয়ারি কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপের অন্যতম ছিল আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন করা। এতে ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমতে শুরু করে। গত ১৯ মার্চ নাগাদ উহানে স্থানীয় সংক্রমণ শূন্যতে নেমে আসে।

ইউরোপের দেশগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারগুলো সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলার পাশাপাশি বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়। তবে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশভেদে ভিন্নতা ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

করোনার সংক্রমণে ইউরোপে বর্তমানে সবচেয়ে নাকাল ইতালি ও স্পেন। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ইতালিতে গত সোমবার পর্যন্ত মারা গেছে ১১ হাজার ৫৯১ জন। গতকাল এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইতালির সরকার সোমবার থেকে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট মৃত্যু ও নতুন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা প্রকাশ করেনি। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকদের গাণিতিক মডেল অনুসারে, সামাজিক দূরত্ব, পুরো দেশ অবরুদ্ধ করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ না নিলে দেশটিতে গতকাল ৩১ মার্চ পর্যন্ত মৃত্যু ছড়াত ৫২ হাজার। অর্থাৎ প্রায় ৪০ হাজার মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

স্পেনে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছে ৮ হাজার ১৮৯ জন। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গাণিতিক মডেল অনুসারে, সামাজিক দূরত্ব, জরুরি অবস্থা জারি ও দেশ অবরুদ্ধ করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এদিন পর্যন্ত দেশটিতে মৃত্যু ছাড়াত ২৪ হাজার। অর্থাৎ স্পেনে প্রায় ১৬ হাজার মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

নেদারল্যান্ডসের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ের প্রকাশিত সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক সাময়িকীতে গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধেও করোনা ঠেকাতে সামাজিক দূরত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, চীনের সাংহাইটেক ইউনিভার্সিটি ও হংকংয়ের চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের একদল গবেষক। এতে বলা হয়, উহান শহর অবরুদ্ধ করা না হলে শুধু চীনেই আরও ৬৫ শতাংশ মানুষ করোনা সংক্রমিত হতো।

চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট–এ গত সপ্তাহে প্রকাশিত অপর এক গবেষণা নিবন্ধেও বলা হয়, সামাজিক দূরত্বের কারণে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গত রোববার এক প্রতিবেদনে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে আবারও বারবার হাত ধোয়া, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি–কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা এবং রোগী ও সন্দেহভাজন রোগীর সংস্পর্শ এড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।