একটু শ্বাস নিতে মরিয়া হয়ে গেলাম

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন; যদিও আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার হার অনেক বেশি।

আসলে করোনায় আক্রান্ত সব ব্যক্তিই যে গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন, তা নয়। কারও কারও মধ্যে করোনার লক্ষণ হালকাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ কেউ টেরও পাচ্ছেন না যে তাঁর শরীরে করোনা। আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে সুস্থ হয়েছেন, এমন মানুষও আছেন। সুস্থ হয়ে ওঠা অনেকের গল্প যেন ভয়ংকর এক শারীরিক যুদ্ধ জয়ের গল্প। তেমন তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি বিবিসিকে বলেছেন নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা। এখানে তা তুলে ধরা হলো:

স্বামীর সঙ্গে ক্যারেন ম্যানারিং। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
স্বামীর সঙ্গে ক্যারেন ম্যানারিং। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

১. নিজের ও বাচ্চাটার জন্য লড়াই করে গেছি
যুক্তরাজ্যের কেন্টের হার্নে বে এলাকায় থাকেন ক্যারেন ম্যানারিং। ৩৯ বছর বয়সী ক্যারেন চতুর্থবারের মতো মা হতে যাচ্ছেন, ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বেশ কাশি আর জ্বর হতে থাকে তাঁর। তবে হাসপাতালের কর্মীরা তাঁকে ভর্তির বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। ১১ দিনের দিন সব পাল্টে গেল।

ক্যারেন বলেন, ওই দিন আমার শ্বাস–প্রশ্বাসে কেমন যেন শব্দ হতে লাগল। আমি ৯৯৯–এ কল করি। কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স আমার বাসার দরজার সামনে চলে আসে। আমি আক্ষরিক অর্থেই একটু শ্বাস নিতে মরিয়া হয়ে গেলাম। ওরা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে অক্সিজেন দেয়।

পরীক্ষায় ক্যারনের কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। তাঁর দুই ফুসফুসেই নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়ে। তাঁকে আলাদা করে ফেলা হয়। এক সপ্তাহ আলাদা রাখা হয়। কাউকে ওই কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হতো না। ক্যারনের ভয়াবহ একা লাগত। মনে হতো যেন নিকষ কালো ছায়া নেমে এসেছে তাঁর জীবনে। হাসপাতালের বেডে দুই থেকে তিন দিন টানা শুয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। টয়লেটেও যেতে পারেননি।

ক্যারেন বলেন, ‘আমার যখন শ্বাসকষ্ট হতো, বেডের পাশে থাকা একটি বেল বাজাতাম। হাসপাতালের কর্মীরা আমার কক্ষে আসার আগে সুরক্ষা সরঞ্জাম পরে আসতেন। ততক্ষণ শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম আমি। নিজেকে শান্ত রাখতে সারাক্ষণ ফোনে পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার সারাক্ষণ মনে হতো আমি মারা যাচ্ছি। আমি প্রতিটি নিশ্বাস নিতে লড়াই করেছি। আমার জন্য আমার বাচ্চার জন্য। আমি আর আমার স্বামী মুখে মাস্ক লাগিয়ে গাড়ির জানালা খুলে যাচ্ছিলাম। বাতাসটা অসাধারণ লাগছিল।’

ক্যারেন এখন বেশ সুস্থ। বাড়িতে সেলফ আইসোলেশনে আছেন। পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে নিজেকে একদম আলাদা রেখেছেন। এখনো শুকনো কাশি আছে তাঁর। আরও এক মাস এমন থাকতে পারে বলেছেন চিকিৎসকেরা।

জেসি ক্লাক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
জেসি ক্লাক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

২. কেবলই মেন হচ্ছিল কেউ একটু সাহায্য করুক
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ডের বাসিন্দা জেসি ক্লাক জানতেন যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাঁর জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ, মারাত্মক কিডনি রোগে ভুগছেন তিনি। পাঁচ বছর আগে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় তাঁর। তাই ২৬ বছর বয়সী জেসি যেদিন থেকে কাশতে শুরু করলেন, ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। তাঁর শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হলো, হাঁটতে পর্যন্ত পারছিলেন না। জেসিবলেন, তাঁর পাঁজরে, পিঠে ও পেটেও প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। মনে হতো কেউ যেন তাঁকে মেরেছে।

এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লকডাউন জারি করেন। দুদিন পর জেসির বাগ্‌দত্তা টম গাড়িতে করে তাঁকে এঅ্যান্ডইতে পৌঁছে দেন। তাঁরা খুব দ্রুত আলাদা হয়ে যান।

জেসি বলেন, ‘আমি একা হতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমার এত খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে সাহায্য করুক।’ হাসপাতাল থেকে জেসিকে একটি সবুজ মাস্ক দেওয়া হয়। এমন একটি কক্ষে তাঁকে রাখা হয়, যে কক্ষে আগে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত রোগী রাখা হয়েছিল।

জেসি বলেন, ‘আমার করোনা টেস্ট করা হয়নি। চিকিৎসকেরা বলেন, তাঁরা সবাইকে পরীক্ষা করতে পারবেন না। তবে এটা ধরে নেওয়াই উত্তম যে আমি আক্রান্ত।’ চিকিৎসক বলেন, ‘ফুসফুসের প্রদাহজনিত কারণে আমার এমন ব্যথা হচ্ছে, তাই তারা আমাকে আলাদা করে ফেলেছেন এবং ব্যথানাশক ওষুধ দিচ্ছেন।’

এর আগে কখনো শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগেননি জেসি। খুব ভয় পাচ্ছিলেন। জেসিকে হাসপাতালে দিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করছিলেন টম। টমের থেকে এই ভাইরাস জেসির শরীরে গেছে, এমনটাই আশঙ্কা করছিলেন তিনি। পরে হাসপাতালে প্রায় ৫ দিন ছিলেন জেসি। এখনো হাঁটতে কষ্ট হয় জেসির। দিনে প্রায় ১৮ ঘণ্টায় ঘুমিয়ে কাটাচ্ছেন। এখনো কাশি রয়েছে তাঁর।

জেসি বলেন, ‘কিছু তরুণ এখনো ভাবছেন তাদের কিছু হবে না। যদিও বেশির ভাগ মানুষ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন। অনেক তথ্যে বলা হচ্ছে, বয়স কম হলে এ ভাইরাস খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। তবে আমি বলব এটা অবশ্যই প্রভাব ফেলে।’

স্টুয়ার্ট বয়েল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
স্টুয়ার্ট বয়েল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

৩. কানে কানে কেউ যেন কিছু বলছিল
স্টুয়ার্ট বয়েল পুরোপুরি নিশ্চিত, কয়েক সপ্তাহ আগে করা একটি সভা থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সামাজিক দূরত্ব মেনেই সভা করতাম আমরা। তবে ওই দিন সভায় এমন কয়েকজন এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে ফ্লুর লক্ষণ ছিল। ওই ঘটনার ১০ দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন ৬৪ বছরের বয়েল। বয়েল প্রথমে খুব হালকা একটা অনুভূতি এল। তবে আমি সিঁড়ি ভাঙতে পারছিলাম না, বয়স্ক মানুষের মতো হাঁপাচ্ছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে আমি ব্যায়াম করার শক্তি হারিয়ে ফেলি। ভাইরাস আমার ফুসফুসে আক্রমণ করে এবং আমি লড়াই করার শক্তি হারিয়ে ফেলি।’

বয়েলের পরিবার ১১১–এ কল করে। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর মনে হচ্ছিল কোনো নিকষ অন্ধকারে আমি, কেউ ফিসফিস করে আমার সঙ্গে কথা বলছে। মনে হলো আমার মনে হয় সময় শেষ। কিন্তু আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করলাম। আমাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার চিকিৎসকেরা অসাধারণ ছিলেন। তবে তারা কেবল আক্রান্ত ব্যক্তিকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করতে পারে। এই অসুখের কোনো ভ্যাকসিন নেই, কোনো জাদুর ওষুধ ও নেই যা আপনাকে বাঁচাতে পারে। সুস্থ হওয়া পুরোপুরি আপনার প্রতিরোধের ওপর নির্ভর করছে।

কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে বয়েল বাড়ি ফিরেছেন, তবে এখনো সেলফ আইসোলেশনে আছেন।