মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরা এক উহানবাসীর কথা

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

চীনের উহানে প্রথম আঘাত হানে অদৃশ্য নির্মম করোনাভাইরাস। ভাইরাসের প্রকোপ কমলেও এ ভাইরাস এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে উহানের বুকে। উহানবাসীর অনেকের মনে এখনো তীব্র ভয় গ্রাস করে আছে। অনেকেই ঘর থেকে বের হয় না। আর অসংখ্য মানুষকে তো ভাইরাস নিয়েই গেছে, যারা আর কখনো ফিরবে না।

গত ২৩ জানুয়ারি উহানে লকডাউন জারি হয়। প্রতিটি ঘরে তালাবদ্ধ জীবন শুরু হয়। পুরো শহরের চিত্রই যেন পাল্টে যায়। সেই দুঃসহ সময় পার হয়ে এসে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দ্য গার্ডিয়ানের কাছে বর্ণনা করেছেন ইউ উয়ং নামের উহানের এক বাসিন্দা। দুই মাস পর ঘর থেকে বের হয়ে যেন নতুন এক দুনিয়ার সামনে আসেন তিনি। যার প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করেছেন তিনি।

ইউ উয়ংয়ের ভাষায় সেই অভিজ্ঞতা
২৩ জানুয়ারির পর থেকে কত কিছু যে সইতে হয়েছে। আমরা ভয়াবহ একটা মহামারি সহ্য করেছি। দিনের পর দিন ঘরে তালাবদ্ধ হয়ে থেকেছি। নানা ধরনের খারাপ সংবাদই পেয়েছি। ভয়, উদ্বেগ আর একরাশ ক্ষোভ নিয়ে সব সহ্য করেছি। অতীতের অনেক বিপর্যয়ের সাক্ষী আমি। সব সময় মনে করতাম, আমি মানসিকভাবে যেকোনো পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য প্রস্তুত। তবে কোনো মানুষের পক্ষেই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়। দুই মাস ধরে কত ভয়াবহ ঘটনা যে ঘটেছে। আমিসহ প্রত্যেক উহানবাসী চেষ্টা করে গেছি কেবল সব সহ্য করে যাওয়ার।
এ সময় অনেকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। আমি মনে করি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার এটা একটি উপায়। অনেক সময় বিষয়গুলো এমন হয়, আপনি খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছনে, তবে মনে করছেন এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমরা এখন সেই ধের্যের মূল্য পাচ্ছি। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে উহানের লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে মৃত্যুর মাঝ থেকে ফিরে আসা এত সহজ নয়। আমাদের জীবন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। আগের মতো করে পেতে আরও কত পথ যে পেরোতে হবে।

লকডাউনের পর গত ২৯ মার্চ প্রথম ঘরের দরজার বাইরে পা রাখি আমি। বসন্ত হলেও বেশ ঠান্ডার একটি দিন। তবে মাইনাস ১০ ডিগ্রির চেয়ে বসন্তের এই দিনটি অনেক উষ্ণ ছিল। আমার বাড়ির বাইরে একটি হোটেলের কাছে একটি মেডিকেল টিম বসে থাকত। আমি জানি না তারা চলে গেছে কি না। তবে হোটেলের দরজাটি যেন এখন একটি উৎসাহজনক কবিতার মতো। রাস্তায় গিয়ে কাউকে হাঁটতে বা সাইকেল চালাতে দেখিনি। আগে বেশ কিছু বাস যেত এই রাস্তা ধরে। কিছু মেট্রো আবার চালু হয়েছে, তবে ট্রেন চলাচল এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। মেট্রোতে উঠলেই নিরাপত্তারক্ষী কত প্রশ্ন করত, এখন যেন সেসব কিছুই নেই।

লকডাউনের সময়টা মানুষ যেন বাড়িগুলো থেকে পালাতে চাচ্ছিল। শহরে যখন আস্তে আস্তে লকডাউন উঠছিল অনেকে তো আর ধৈর্য রাখতে পারছিল না। আমার এক বন্ধু লেকের কাছে গিয়ে একগাদা ছবি তুলে ফেলে। অনেকে অফিসে গিয়ে ছবি তুলেছেন। কেউ কেউ তো ম্যাকডোনাল্ডস আর স্টারবাকসের হোম ডেলিভারি পেয়েও ছবি তুলে ফেলেছিলেন। সবাই খুশি হয়ে উঠেছিল, এটিকে স্বাভাবিক জীবনের সূচনা হিসেবেই দেখছিলেন।

তবে তালাবদ্ধ জীবনের সমাপ্তির পুরোটা জুড়ে যে আনন্দ ছিল তা নয়। কিছু মানুষ আমার মতোই দ্বিধায় ছিল। আমি এ সময়ে অনলাইনে ক্লাস নিতে অভ্যস্ত হয়েছি। লকডাউন ওঠার পর মাঝেমধ্যে বাসা থেকে বের হই। আমার জানালার ওপারটা অসম্ভব শান্ত ঠেকে আমার কাছে। ঘর থেকে বের হয়ে, শহরটাকে আবার ফিরে আসতে দেখা, আবার কোলাহলের শব্দ কেমন যেন আজব ঠেকে এখন। একদিকে সবাই চেষ্টা করছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে, একদিকে লকডাউনের সেই অনুভূতি ফিরে ফিরে আসছে।

করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় প্রতি ১০ দিন পরপর আমি হাসপাতালে আমার দাদির জন্য খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যেতাম। দাদির স্ট্রোক হয়েছিল। যখন জরুরি অবস্থা শুরু হলো, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সব সময় অ্যাম্বুলেন্স দেখতাম। সব সময় কোনো না কোনো পরিবার কাঁদত। ২৯ তারিখ এসে দেখি হাসপাতাল খুব শান্ত হয়ে আছে। একটা মাত্র অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং লটে অন্য গাড়ির সঙ্গে দাড়িয়ে ছিল। কোনো পরিবারকে কাঁদতে দেখিনি।
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় বেশি মানুষ দেখিনি, তবে অনেক গাড়ি ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ রাস্তায় বসে পড়েছেন, তাঁর সঙ্গে থাকা আরেক ব্যক্তি তাঁকে তোলার চেষ্টা করছেন। তাঁদের কারও মুখেই মাস্ক ছিল না। ঘটনাটি দেখে আমার প্রাদুর্ভাবের প্রথম সময়টার কথা মনে পড়ে যায়, যখন হঠাৎ করেই রাস্তায় মানুষকে পড়ে যেতে দেখতাম। ভয়ে কেউ এগিয়ে যেত না। দূর থেকে শুধু তাকিয়ে দেখত।
এবার হঠাৎ করেই আমি এগিয়ে যাওয়ার সাহস করলাম। আমার কাছে বাড়তি মাস্ক ছিল, বললাম লাগবে কি না। অসুস্থ অনুভব করছেন কি না, জানতে চাইলাম। তবে যে উত্তর এল, তা আশা করিনি। মানুষটির কিছুক্ষণ আগে তার প্রেমিকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। স্পষ্টতই এই কষ্ট তাকে এখন মহামারির চেয়ে বেশি আঘাত করছে।