করোনা মোকাবিলায় যে কৌশলে এগিয়ে দরিদ্র এই দেশগুলো

সম্পদ সীমিত ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো দুর্বল। কিন্তু দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে করোনা মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সফল কয়েকটি দেশ। ছবি: রয়টার্স
সম্পদ সীমিত ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো দুর্বল। কিন্তু দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে করোনা মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সফল কয়েকটি দেশ। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন বা জার্মানির মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ নয় তারা। যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাড়া দেওয়ার মতো যথেষ্ট সামর্থ্যও নেই তাদের। অর্থনীতি, চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে দারুণভাবে এগিয়ে থাকা উন্নত দেশগুলোতে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তখন তা থেকে বাদ যায়নি দরিদ্র ওই দেশগুলোও। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ ও সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকা এ দেশগুলো এখন পর্যন্ত সফলভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এখনো বেশ কম। এমন চারটি দেশকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার

দরিদ্র এই দেশগুলোর এমন সাফল্যের পেছনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে তাদের সরকারের মরিয়া চেষ্টাকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন মহামারি রোগ বিশেষজ্ঞরা। এই বিশেষজ্ঞদের একজন নাইজেরিয়ার চিকউয়ি হেকওয়েজু।

ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারিতে শহরটি পরিদর্শনে যান চিকউয়ি। নাইজেরিয়ার রোগনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (এনসিডিসি) এই মহাপরিচালকের কথায়, ‘উহানের ওই দৃশ্য ছিল অবিশ্বাস্য। বিরাট এই শহর দেখতে খালি মনে হলেও জানালার অপর পাশে থাকা প্রতিটি পরিবারে মজুত রয়েছে জীবন বাঁচানোর মতো প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধ ও অপরিহার্য অন্য সব সামগ্রী।’

কিন্তু এখন এ বিশেষজ্ঞের দৃষ্টি নাইজেরিয়ার ঘিঞ্জি, কোলাহলপূর্ণ শহর লাগোসসহ দরিদ্র দেশগুলোর বিভিন্ন শহরের দিকে। দেশগুলোর এক বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠীর বসবাস খোলা আকাশের নিচে, অনানুষ্ঠানিক আশ্রয়শিবিরে। সেখানে নেই বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। দেশগুলোতে করোনার মতো দুর্যোগ মোকাবিলা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। চিকউয়ি বলেন, পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশগুলো হাল না ছেড়ে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন: লাগোসের নগর কর্তৃপক্ষ গত ৩০ মার্চ থেকে সড়ক ও আকাশপথে অন্য সব শহরের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ রেখেছে ব্যবসা-বাণিজ্যও।

উন্নত হাসপাতাল ও চিকিৎসাব্যবস্থার ঘাটতির মধ্যেও নাইজেরিয়া এবং অন্যান্য নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো সংক্রমণ শনাক্তের শুরু থেকেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর আগে থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জরুরি ছাড়া অধিকাংশ কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া, লোকজনকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে লকডাউন কার্যকর করা, সম্ভাব্য করোনা রোগী শনাক্তে দ্রুত নিজেদের মতো করে পরীক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া ইত্যাদি।

নাইজেরিয়া

গত ৩ ফেব্রুয়ারি চিকউয়ির পরীক্ষাগারে করোনা শনাক্তে প্রথম নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর পরপরই করোনা নিয়ে চীনের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে দেশটি সফরে যান তিনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি নাইজেরিয়া সে দেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম ঘটনা নিশ্চিত করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ইতালির মিলান থেকে লাগোসে ফিরেছিলেন। সংক্রমণের ঘটনা নিশ্চিত করার তিন দিনের মধ্যে নাইজেরিয়ার একদল বিশেষজ্ঞ এই ভাইরাসের জেনম সিকোয়েন্স তৈরি করে তা অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেন। গত ১৮ মার্চ সংক্রমণের সংখ্যা আটজন হওয়ার পর নাইজেরিয়া কর্তৃপক্ষ চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজনের আসা বন্ধ করে দেয়। ২৯ মার্চ থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও বন্ধের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি। সেই সঙ্গে লোকজনের অপ্রয়োজনীয় যাতায়াত বন্ধে রাস্তায় রাস্তায় বসানো হয় তল্লাশিচৌকি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখন দৈনিক ৫ থেকে ১০ হাজার জনের করোনা শনাক্ত পরীক্ষার পথে এগোচ্ছে দেশটি।

পেরু

প্রথম সংক্রমণের ঘটনা শনাক্তের পর কালবিলম্ব না করে দেশটিতে কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। ১৫ মার্চ সংক্রমণ প্রায় ৭০টিতে উন্নীত হলে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সীমান্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। লোকজনকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। জারি করা হয় কারফিউ। আইন ভাঙায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২১ হাজার মানুষকে। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র ও শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষকে অর্থ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। জোর দিয়েছে করোনা পরীক্ষার ওপর।

কেনিয়া

২৫ মার্চ সংক্রমণের ঘটনা ২৫টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে দেশে কারফিউ জারি রয়েছে। লকডাউন কার্যকর করতে মাঝেমধ্যে আকাশে হেলিকপ্টারে টহল দিচ্ছে পুলিশ। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের পেটাতে ও ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তেও কার্পণ্য করছে না পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে গুলি ছোড়ারও। বাসিন্দারা বলছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও কারফিউ কার্যকরে পুলিশ খুবই সহিংস পন্থা অবলম্বন করছে। কেনিয়া মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ইভান্স মুকোয়ি বলেন, লোকজনকে বশে রাখা বেশ কঠিন হলেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে কর্তৃপক্ষ কড়াকড়িভাবে নানা বিধিনিষেধমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেননা বেইজিংয়ে এ রকম আগাম পদক্ষেপ ভালো ফল দিয়েছে। তবে নাইজেরিয়া ও পেরুর মতোই করোনা শনাক্তের পরীক্ষা জোরদারে ঘাম ঝরাচ্ছে দেশটি।

এল সালভাদর

বিশ্বের হাতে গোনা যে কয়টি দেশ কোভিড-১৯–এ দ্রুত সাড়া দিয়েছে, এটি সেগুলোর একটি বলে জানিয়েছেন মেডিসিন স্যান ফ্রন্টিয়ার্সের (এমএসএফ) উপপ্রকল্প সমন্বয়ক লুইস রোমেরো পিনেডা। দেশটিতে সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত হওয়ার আগেই সরকার ১৩ মার্চ থেকে ক্লাস, খেলাধুলা ও ২০ জনের বেশি লোকের একত্র হওয়া নিষিদ্ধ করে। চার দিন পর সংক্রমণের শিকার দেশের সঙ্গে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এক দিন পর ইতালিফেরত একজনের মধ্যে সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করে সরকার। এর কিছুদিন পর দেশবাসীকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর লকডাউনের পাশাপাশি জারি করা হয় কারফিউ। পাশাপাশি অব্যাহত আছে অর্থ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম।