জার্মানিতে করোনায় যে কারণে মৃত্যুহার কম

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

জার্মানিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষ। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও স্পেনে। এর পরই জার্মানি। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে জার্মানি ওপরের দিকে থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে দেশটি অনেক পেছনে। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যুহার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ ইতালিতে এই হার ১২ শতাংশ। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও স্পেনে ১০ শতাংশের আশপাশে।

জার্মানিতে মৃত্যুহার এত কম কেন—এ নিয়ে সারা বিশ্বেই কৌতূহল রয়েছে। এর উত্তর খুঁজতে হলে একটি নয়, একাধিক কারণের দিকে তাকাতে হবে।

এক দশক ধরে প্রায় প্রতি সপ্তাহে জার্মানিতে যাই। কাজের প্রয়োজনে। জার্মান মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও সমাজকে বেশ কাছ থেকে দেখছি। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, গুছিয়ে কাজ করা, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা জার্মান সংস্কৃতির অংশ। কোনো সমস্যার সমাধানে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা আর তার নিখুঁত বাস্তবায়নে জার্মানদের জুড়ি মেলা ভার।

জার্মানিতে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ দেখা যায় ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। কিন্তু জানুয়ারিতেই সরকার করোনাভাইরাস শনাক্তে ব্যাপক হারে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। বার্লিনের খ্যাতনামা স্যারিটে হাসপাতালের গবেষণাগারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পরীক্ষা করার পদ্ধতি তৈরির। জানুয়ারি শেষ হতেই করোনা পরীক্ষার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। অনলাইনে এ-সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর ফলে জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলের গবেষণাগারগুলো একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভাইরাসটি শনাক্তে পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক ও যন্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করে। অথচ উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখনো এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম অপ্রতুল। যুক্তরাজ্যে বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে ৫৬ হাজার টেস্ট করা হচ্ছে। জার্মানিতে এই সংখ্যা পাঁচ লাখ।

জার্মানিতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই ব্যাপক হারে টেস্ট করা শুরু হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ শুরু হয় ইতালি, ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ডে ছুটি কাটিয়ে আসা মানুষদের। উদ্দেশ্য, আক্রান্ত মানুষকে দ্রুত অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলা। যাদের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ, তাদের দ্রুত নেওয়া হয় হাসপাতালে।

জার্মানিতে হাসপাতালের পরিকাঠামো বিশ্বসেরা। হতেই হবে। জার্মানিতে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বরাদ্দের পরিমাণ যুক্তরাজ্য, ইতালি বা ফ্রান্সের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ বা রোগনির্ণয়ের পরীক্ষা তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই দ্রুত করা যায়।

জার্মান হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত বেডের (শয্যা) সংখ্যা ৪০ হাজার। ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও পর্যাপ্ত। তাই জার্মানিতে রোগনির্ণয় দ্রুত শুরু হয়। একই সঙ্গে কেউ গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। জার্মানিতে সংক্রমণের শুরু থেকেই এ পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল। বিপরীতে ইউরোপের অন্য দেশ বা যুক্তরাষ্ট্রে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলেই কেবল পরীক্ষা করা হচ্ছে; দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা।

করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় জার্মান সরকার সফল। শুরু থেকেই জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল কোনো সময় নষ্ট না করেই দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বলা হচ্ছে, জার্মান সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার পথ অনুসরণ করে ব্যাপকভাবে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এটি ফলপ্রসূও হয়েছে। ম্যার্কেলের গ্রহণযোগ্যতা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। তিনি দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেখিয়ে এর আগেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ইউরোপের দেশগুলোকে মন্দা কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সিরিয়ার শরণার্থীদের ম্যার্কেল জার্মানিতে আশ্রয় দিয়েছেন।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সিদ্ধান্ত এতটাই কার্যকর যে দেশের ভেতরে কোনো মহল থেকেই এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ফলে মহামারি মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য স্থাপনেও তিনি সফল। রাজনীতিতে আসার আগে ম্যার্কেল ছিলেন পেশাদার বিজ্ঞানী। রসায়নে পিএইচডি। তাই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তিনি যে সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন, সে বিষয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষ নিশ্চিত ছিলেন। সংকটের সময় দেশের মানুষকে টেলিভিশন মারফত নিয়মিত নির্দেশনা দিয়েছেন। দোকানে গিয়ে বাজার করেছেন, পত্রিকা কিনেছেন প্রতিদিনের মতো। বৈশ্বিক এ সংকটে ম্যার্কেল যে শান্ত, স্বাভাবিক অথচ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন, তা-ই জার্মানিকে এখনো রক্ষা করে চলেছে।

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
[email protected]