জাপানের জরুরি অবস্থাকে যে কারণে মানতে পারছেন না রিউইচি সাকামোতো

রিউইচি সাকামোতো
রিউইচি সাকামোতো

জাপান সরকার জরুরি অবস্থার অংশ হিসেবে দেশটির সব সংগীত তারকাকে স্বেচ্ছায় কনসার্ট বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। তবে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেনি। এর ফলে দুর্যোগের এই সময়ে সংগীত থেকে দূরে থাকার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না শিল্পী ও সংগীত পরিচালক রিউইচি সাকামোতো। তিনি এই পদক্ষেপকে অশুভ সংকেত হিসেবে দেখছেন।

রিউইচি সাকামোতো শুধু জাপানেই নয়, জাপানের বাইরেও সংগীত পরিচালক হিসেবে সমধিক পরিচিত। ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’ এবং ‘মেরি ক্রিসমাস মিস্টার লরেন্স’-এর মতো একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করা ছায়াছবির সংগীত পরিচালক তিনি। পাশাপাশি নিজের সামাজিক দায়িত্ববোধ, বিশেষ করে দুর্যোগকালীন দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার জন্যও জাপানে তিনি সমাদৃত। ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামির পর সারা জাপান যখন শোকার্ত ছিল, কঠিন সেই সময়ে তিনি রচনা করেছিলেন অনবদ্য এক সংগীত। ‘জীবনের মৃত্যু নেই’ শিরোনামের সেই সংগীতের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে রুশ কবি আরসেনি তার্কোভস্কির ‘জীবন, জীবন’ শিরোনামের একটি কবিতা।

৬৮ বছর বয়সী এই গুণী সংগীতকার নিজে হচ্ছেন খ্যাতিমান পিয়ানোবাদক। প্রায় এক দশক ধরে ক্যানসারের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাওয়ার পাশাপাশি সংগীতচর্চা তিনি অব্যাহত রেখেছেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণা নিয়ে জাপানের নেতৃস্থানীয় দৈনিক ‘আসাহি শিম্বুন’-এর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেন রিউইচি সাকামোতো। বর্তমানে তিনি তোহোকু ইয়ুথ অর্কেস্ট্রার সংগীত পরিচালক ও প্রতিনিধি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালের দুর্যোগের পর থেকেই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেই অঞ্চলটির সঙ্গে গড়ে উঠে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক, যদিও তিনি নিজে টোকিওবাসী।

জাপান সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে কেবল অগোছালো ও এলোমেলোই নয়, একই সঙ্গে অশুভ সংকেত হিসেবেও দেখছেন রিউইচি সাকামোতো। তাঁর মতে করোনাভাইরাসের বিস্তার শিল্পীদের হঠাৎ করে কঠিন এক অবস্থার মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে সিডি রেকর্ডের বিক্রি পড়ে যাওয়ায় এঁদের অনেককেই এখন শুধু কনসার্টের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু কনসার্ট বাতিল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নতুন এক সংকট তাঁদের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে। সাকামোতো মনে করেন, গীতিকারদের প্রতি পূর্বনির্ধারিত কনসার্ট বাতিল করে দেওয়ার আহ্বান জানানোর আগে সরকারের উচিত ছিল যে ক্ষতির মুখোমুখি তাঁদের হতে হচ্ছে, তা পূরণ করে দেওয়ার একটি ব্যবস্থা ঠিক করে নেওয়া। তা না করে সরকার যা করেছে, সেটাকে তিনি শিল্পীদের প্রতি অবিচার হিসেবে দেখছেন।

সাকামোতো বলেন, ‘মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির একটি অংশ এবং প্রকৃতির এ রকম আচরণের বিরুদ্ধে আমাদের খুব বেশি করার নেই। যা করা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংক্রমণের বিস্তার ঠেকিয়ে রাখা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারাকে বাধাগ্রস্ত করে নয়।’ তিনি বলেছেন, ‘মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে বারবার এ রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হলেও সংগীত কখনো হারিয়ে যায়নি। ফলে পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে চলার জন্য নতুন পথের সন্ধান করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমাদের নেই এবং সেই পথের সন্ধান দিতে না পারলেও কঠিন সময়ে সান্ত্বনার বাণী সংগীত অন্তত শোনাতে পারে।’ সংস্কৃতির এই দিকটিকে সাকামোতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ফলে সংস্কৃতির গুরুত্ব নিয়ে সরকারের ভেতরের লোকজন কী ভাবছেন, সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। সরকার কি সংগীতজগতের লোকজনকে পরিত্যাগ করতে চাইছে, নাকি সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসে এঁদের সাহায্য করতে চাইছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্যে তার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি বলে তিনি মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে রিউইচি সাকামোতো তাঁর প্রয়াত বন্ধু, শিল্পী কিওশিরো ইমাওয়ানোর একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সেই বন্ধু বলতেন, ‘ক্ষমতাসীন লোকজন একটি সংকটের অপব্যবহার সহজেই করতে পারে। ভূমিকম্পের পর সাধারণত যুদ্ধ আসে। ফলে সাবধান!’

প্রয়াত বন্ধুর উচ্চারিত সতর্কতার প্রসঙ্গ টেনে জরুরি অবস্থা ঘোষণায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন সাকামোতো। তিনি নাৎসি জার্মানির জরুরি অবস্থার সুযোগ কাজে লাগানোর কথা মনে করিয়ে দেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পথ করে দেওয়া সাম্প্রতিক আইনগত সংশোধনকে তিনি খুবই বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন। এর ফলে তিনি বলতে দ্বিধা বোধ করেননি, ‘আমার মনে হয় আজ থেকে অনেক বছর পর এটাকে তেমন এক ঘটনা হিসেবে দেখা হবে যা কিনা স্বৈরতান্ত্রিক ধারার কাছাকাছি আমাদের আরও একধাপ নিয়ে যায়।’

জরুরি অবস্থা নিয়ে দোটানায় জাপান
এদিকে জরুরি অবস্থায় কোন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে, আর কোনগুলো থাকবে না, তা নিয়ে এখনো দোটানায় ভুগছে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি টোকিওর মেট্রোপলিটন প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাঁর ভাষণে কোনো তালিকা দেননি, কেবল বলেছেন, জনবহুল স্থানগুলো যেন এড়িয়ে যাওয়া হয়। এর আগে টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকে বলেছিলেন, জরুরি অবস্থার আওতায় হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসি, সুপারমার্কেট এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনের কেনাকাটা করার দোকানপাটের বাইরে অন্য সবকিছু বন্ধ থাকবে। তবে সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালতের কী হবে, তার কোনো নির্দেশনা সেখানে ছিল না এবং প্রধানমন্ত্রীও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। ফলে জাপানের প্রধান শহরগুলো অফিস চলাকালীন জনশূন্য হয়ে পড়লেও সকাল ও সন্ধ্যায় জনসমাগম সেসব জায়গায় ঠিকই হচ্ছে।

অন্যদিকে যে সাতটি জেলাকে জরুরি অবস্থার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রশাসন নিয়েছে, সেগুলো নিয়েও এখন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার সংখ্যাগত দিক থেকে পঞ্চম স্থানে এবং মোট মৃত্যুর হিসাবের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা আইচি জেলা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন। এমনকি আইচির গভর্নরও এখন চাইছেন তাঁর জেলাকে যেন জরুরি অবস্থার বাইরে না রাখা হয়।

তবে কেন আইচি বাদ পড়েছে তার কিছু সম্ভাব্য কারণের দিকে জাপানের সংবাদমাধ্যম এখন আলোকপাত করতে শুরু করেছে। আইচি হচ্ছে শিল্পাঞ্চল কেন্দ্রীভূত থাকা একটি জেলা এবং টয়োটা মোটরসহ বেশ কিছু প্রধান উৎপাদকদের শিল্পকারখানা সেখানে অবস্থিত। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্যিক লবির চাপ কিংবা অর্থনৈতিক দিকের লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে সরকার হয়তো আইচি জেলাকে জরুরি অবস্থার বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে জাপানের রাজধানীসহ সারা দেশে করোনা সংক্রমণ এখনো ঊর্ধ্বমুখী। জরুরি অবস্থার প্রথম দিনে গতকাল জাপানে পাঁচ শতাধিক নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়। এর মধ্যে টোকিওতে শনাক্ত করা হয়েছে ১৪৪টি। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সব মিলিয়ে জাপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত করা হয়েছে ৬ হাজার ৪ টি। এদের মধ্যে ১১৭ জন প্রাণ হারিয়েছে।