করোনাভাইরাস: শিক্ষা না নিলে আরেকটি মহামারি অবশ্যম্ভাবী

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

আমরা জানতাম এটা আসছে। ১৯৯৪ সালে পুলিৎজারজয়ী বিজ্ঞানবিষয়ক মার্কিন সাংবাদিক এবং লেখক লরি গ্যারেট এমন পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। ‘দ্য কামিং প্লেগ’ বইতে তিনি লিখেছিলেন, ‘মানব জাতি যখন নিজেরাই আরও বেশি জনাকীর্ণ ভূমি এবং দুষ্প্রাপ্য সংস্থান নিয়ে লড়াই করে, তখন তার সুবিধা জীবাণুর আদালতে চলে যায়। ...হোমো সেপিয়েন্সরা যদি যুক্তিবাদী বৈশ্বিক গ্রামে বাস করতে না শেখে এবং ভাইরাসের জন্য সুযোগ সীমিত না করে, তবে ভাইরাস জয়ী হবে।’

যদি এ লেখকের ভাষা অতিরঞ্জিত মনে হয় তবে ২০০৪ সালে মার্কিন মেডিসিন ইনস্টিটিউটের আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ বিবেচনা করুন। এটি গ্যোথের উদ্ধৃতি দিয়ে ২০০৩ সালের সার্স প্রাদুর্ভাবের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো মূল্যায়ন করেছে। যাতে বলা হয়েছে, জানাটাই যথেষ্ট নয়; আমাদের অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। ইচ্ছা যথেষ্ট নয়; আমদের অবশ্যই করে দেখাতে হবে। সার্সের দ্রুত দমন জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সাফল্য, তবে এটি একটি সতর্কতাও। আবার যদি সার্স ফিরে আসে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চরম চাপের মধ্যে পড়বে। অব্যাহত সতর্কতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

এ সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাইরাস সৃষ্ট মহামারি নিয়ে আগে থেকে সতর্কবার্তা থাকলেও বিশ্ব ওই সতর্কবার্তা অবহেলা করেছে।

২০১২ থেকে ২০১৯ সালে দায়িত্ব পালন করা যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ইয়ান বয়ড স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির জন্য প্রচলিত চিকিৎসা চর্চার কথাই ধরুন। এতে সে সময় প্রায় দুই লাখ লোক মারা গিয়েছিল। যা আমাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয়। কিন্তু ওই অভিজ্ঞতা থেকে সরকার কোনো শিক্ষা নিয়েছিল? মহামারিতে কী কী সাহায্য করতে পারে তা আমরা জেনেছি কিন্তু প্রয়োজনীয় সে পাঠগুলো আর প্রয়োগ করা হয়নি। এসব পাঠ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ যাই হোক না কেন, সত্যটি রয়েই গেল।’

সার্স-কোভ-২ এর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া দাঁড়িয়েছে যে, এটি একটি প্রজন্মের বিজ্ঞান নীতির সবচেয়ে ব্যর্থতা। সংকেতগুলো পরিষ্কার ছিল। ১৯৯৪ সালে হেনড্রা, ১৯৯৮ সালে নিপা, ২০০৩ সালে সার্স, ২০১২ সালে মার্স ও ২০১৪ সালে ইবোলার মতো মহামারি ভাইরাসে কারণে ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে ভাইরাস প্রাণী শরীর থেকে উদ্ভূত হয়ে মানুষের মধ্যে চলে এসেছে। সার্স সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসটি নতুন রূপ নিয়েই কোভিড-১৯ সৃষ্টি করেছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সতর্কবার্তার লক্ষণগুলো যে অবহেলা করা হয়েছে তা, অবাক করা কোনো ঘটনা নয়। আমাদের মধ্যে কম লোকের মহামারি মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না এমন তথ্য অবহেলার দায়ে দুষ্ট। বিপর্যয় মানুষের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা প্রকাশ করে। কেউ এলোমেলো বিরল ঘটনার জন্য কীভাবে পরিকল্পনা করতে পারে? যেমন—ভূমিকম্পবিদ লুসি জোন্স তাঁর ২০১৮ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য বিগ ওয়ানস’-এ যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনিবার্য; বিপর্যয় নয়’।

এসব ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিককে রক্ষা করা। মহামারিজনিত ঝুঁকিগুলো পরিমাপ এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়। লেখক লরি গ্যারেট ও ইনস্টিটিউট অব মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকে এইচআইভির উৎপত্তির পর থেকেই নতুন মহামারির বিপদগুলো আঁচ করা যায়। এরপর থেকে ওই ভাইরাসে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ও ৩ কোটি ২০ লাখ লোক মারা গেছে। তবে সার্স-কোভ-২ যেভাবে ছড়িয়েছে এত দ্রুত এইচআইভি ছড়ায়নি। তবে, ওই ভাইরাসের শিক্ষা থেকে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ভাইরাসের মহামারি ঠেকানোর প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

সাধারণত দেখা যায়, কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে জনসাধারণ ও রাজনীতিকেরা বিশেষজ্ঞদের মুখাপেক্ষী হন। তবে এবারে গবেষকেরা ভুল ধারণা দিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যে ধারণা করা হয়েছিল, এবারের মহামারি বড়জোর ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো হবে। এ ভাইরাসটির কারণে ২০১৪-১৫ সালের দিকে ২৮ হাজার ৩৩০ জন মারা যান। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা আর কোভিড-১৯ তো আর এক নয়।

অন্যদিকে, চীন তাদের সার্সের অভিজ্ঞতা থেকে আগে থেকেই ভয় পেয়েছিল। যখন তাদের সরকার নতুন ভাইরাসের ছড়ানোর বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল তখন আর শুধু হাত ধোয়া বা হাঁচি কাশির শিষ্টাচার মানার পরামর্শে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা পুরো শহর কোয়ারেন্টিন করে সেখানকার অর্থনীতি থামিয়ে দেয়। যুক্তরাজ্যের সাবেক একজন স্বাস্থ্যসচিব বলেছেন, কোভিট–১৯ নিয়ে যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মৃদু হুমকি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

ঝুঁকি নির্ণয় ব্যর্থতার কারণেই সংক্রমণের তরঙ্গ ঠেকানোর কাজে মারাত্মক বিলম্ব ঘটে যায়। সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মীদের কাছ থেকে যে মরিয়া আবেদন পাওয়া যায়, তা পড়তেও কষ্ট হয়। অনেক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী মনে করেন, তারা অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধে নামতে যাচ্ছেন। অনেকেই একে আত্মহত্যা বলে মন্তব্য করেন। কেউ কেউ নিজেকে হিরো বলার চাইতে বাধ্য হয়ে কাজে থাকার কথা বলেন।

গার্ডিয়ান বলছে, যুক্তরাজ্যে অনেক চিকিৎসক ও সেবাকর্মীর জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের ঘাটতির বিষয়টি খুবই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় নিরাপদ সরঞ্জাম সরবরাহ করতেও পারেনি। প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে সরকারের মুখপাত্র বারবার একই কথা আওড়ে চলেন। ‘আমরা প্রতিটি মেডিকেল ও বৈজ্ঞানিক পরামর্শ মেনে চলছি।’ এ বাক্যটি শুনতে ভালো লাগলেও তা আংশিক সত্য। সরকার নিজেও জানত এনএইচএস অপ্রস্তুত ছিল। তারা যথেষ্ট আইসিইউ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। একজন চিকিৎসক বলেছেন, দেখে মনে হচ্ছে যে ইতালি, চীন, স্পেনে ঘটে যাওয়া মানব ট্র্যাজেডি থেকে কেউ শিখতে চায় না। এটা খুবই দুঃখজনক। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরাও একে অন্যকে দেখে শিখতে চান না।’

আমরা সম্ভবত অ্যানথ্রোপসিনের যুগে জীবনযাপন করছিলাম যেখানে মানুষের কার্যকলাপ পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অ্যানথ্রোপসিনের ধারণা মানুষের সর্বশক্তিমত্তার ধারণাটিকে বোঝায়। কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের সমাজের বিস্ময়কর দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এটি সহযোগিতা, সমন্বয় এবং একসঙ্গে আমাদের কাজ করার অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। তবে আমরা প্রাকৃতিক বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাই, আমরা একসময় নিজেদের যে ক্ষমতাধর ভাবতাম আমরা আসলে তা নই।

কোভিড-১৯ যদি শেষ পর্যন্ত মানুষের অহংকার কিছুটা কমাতে পারে, তবে এ মারাত্মক মহামারি থেকে তারা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করবে। তা না হলে, আমরা আমাদের আত্মতৃপ্ত ব্যতিক্রমী সংস্কৃতিতেই ডুবে যাব এবং পরবর্তী মহামারির জন্য অপেক্ষায় থাকব, যা বলা যায় অবশ্যম্ভাবী। সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে, আমাদের ধারণার চেয়েও দ্রুত সেই মুহূর্ত এসে হাজির হতে পারে।