করোনা পরের বিশ্ব সুন্দর না অসুন্দর হবে

করোনাভাইরাসই কি পাল্টে দেবে বিশ্বকে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসই কি পাল্টে দেবে বিশ্বকে। ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানের কাবুলের বস্তি থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলের শহরতলিতে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে স্পর্শ করেনি। করোনা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্বেগ বাড়ছে। অবশ্য যতটা স্বাস্থ্য নিয়ে, এর চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে।

হয়তো এই উদ্বেগেই বিশ্বের চেহারা পাল্টে যাবে। আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফাম বলছে, প্রায় ৯৫ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া নতুন এই করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে যেভাবে বিপর্যস্ত করছে, এতে জরুরি ব্যবস্থা না নিলে উন্নয়নশীল দেশের ৫০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মুখে পড়তে পারে। মানুষের চোখের সামনে যে উদ্বেগ বাড়ছে, তা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অক্সফামের এই সতর্কবার্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে চিন্তার বিষয় হলো, এই মুহূর্তে কি আমূল পরিবর্তন আনার কোনো সুযোগ রয়েছে? শুধু উন্নয়নশীল দেশ, না উন্নত দেশের পক্ষেও কি এটা সম্ভব? এটা কি ন্যায়সংগত হবে, যে শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা পান না, তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় কাজে যেতে বাধ্য করা। কারণ, তাঁরা তো আরও অনেককে সংক্রামিত করবেন। এটা কি ঠিক হবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে স্থানীয় কফি শপটি বন্ধ করতে বাধ্য করা?

দেখা যাচ্ছে, মালিক তো ক্ষতির মুখে পড়ছেনই, সারা মাস কাজ করে হঠাৎ কোনো বেতন না পেয়ে বসে থাকতে হচ্ছে কর্মচারীটিকে।

এ বিষয়ে অক্সফামের অর্থনীতিবিদ ম্যাক্স লসনের কাছে আল–জাজিরার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, এই পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। তিনি বলেন, বর্তমান এই সংকট অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাচ্ছে। ব্যক্তির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য যেখানে তাকেই দায়ী করা হয়, সেখানে এখন সরকারগুলো করপোরেট ব্যবসার পাশাপাশি একক ব্যক্তিকে সহায়তা করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখন এই চিন্তা সারা বিশ্বেই বিকাশ লাভ করছে।

ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমস সম্প্রতি একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। বিশ্বের এমন সময়ে একটি সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বা ইউনিভারসাল বেসিক ইনকামের (ইউবিআই) সুবিধার কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেছে স্পেন। দেশটির অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনাভাইরাস সংকটের আলোকে ইউবিআই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রবর্তন করতে চাইছেন তাঁরা। এ ছাড়া করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে যাঁরা, তাঁদের আগে সহায়তা করা হবে বলছে যুক্তরাজ্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উন্মোচন করেছেন দুই লাখ কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ।

দেখা যাচ্ছে, এবারের চিত্র ২০০৮ সালের চেয়ে বেশ ভিন্ন। কারণ, ওই আর্থিক সংকটে আলাদা বা একক ব্যক্তির সহায়তা করার কথা ভাবেনি কোনো সরকার। সরকারগুলো অর্থ সহায়তা দিয়েছিল কেবল ব্যাংক ও করপোরেশনগুলোকে এবং ব্যাপক ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছিল, ফলে উন্নত দেশের সাধারণ মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওইটাই ওই সময়ের একটি প্যাটার্ন ছিল। তবে এবারের সংকট সব ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এবার দ্রুত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তিদের ঋণ মওকুফ, নগদ প্রদান, করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। মাত্র ১ শতাংশ বা করপোরেট জগৎকে বাঁচানোর জন্য অর্থসহায়তা নয়, সবার জন্য করা হচ্ছে।

লসন বলেন, ২০০৮ সালে মন্দার পরে আর্থিক খাতের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে এলিটরা সব সময় নিজের কথাই ভেবেছে। তবে উচ্চবিত্তরা কি এখন বুঝতে পারছে সাধারণ মানুষ যে হুমকির মুখে আছে, সে হমকির মুখে তারাও আছে। করোনাভাইরাস ধনী–গরিব ভেদাভেদ করে না। দেখে না কে কারখানার প্রধান আর কে শ্রমিক। এই সংকটের উত্তর কেবল একক ব্যক্তিকে অর্থ প্রদানের মধ্যে নয়। তবে অতীতে যে বিষয়গুলো সমাজতন্ত্র বলে বিবেচনা করা হতো, এখন সেটাই বোধগম্য হচ্ছে।

এখন দেখা যাক, যখন এই বিশ্ব করোনাভাইরাস মুক্ত হবে, তখন সর্বজনীন ন্যূনতম আয়, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, ঋণ মওকুফ, কর মুক্তি এসব ধারণারও মৃত্যু হয় কি না।