মধ্যরাতে মায়ের ফোন

অলংকরণ : আরাফাত
অলংকরণ : আরাফাত

জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিলাম। পরিবেশ সুবিধার নয়। আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। গত কয়েকটা মাস পৃথিবীটা কেমন পাল্টে গেল। সারাক্ষণ কাটছে আতঙ্কের মধ্যে। খুদে এক ভাইরাস পুরো মানবজাতিকে ত্রাসের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

দেশ থেকে মা প্রতিদিন পাঁচ-ছয়বার ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছেন। কেমন আছি, কী খাচ্ছি। বারবার হাত পরিষ্কার করছি কি না। আর একটি কথাই ঘুরিয়েফিরিয়ে বলছেন বারবার, ‘খবরদার, বাইরে যাবি না। কারও দেওয়া খাবার খাবি না। যেখানে বেশি মানুষের জমায়েত, সেখানে যাবি না। সচেতন থাকবি।’ আরও কত কিছু যে মা বলেন। ফোন রাখতেই চান না।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের কথা। দুপুরবেলা অফিস থেকে ফোন এল। ৮ এপ্রিল থেকে আমার দিনের পালা। আগে ছিল রাতের পালা। আমার রুমমেট আমাকে ডেকে বলল, ভাই, আসরের সময় হয়েছে। অজু করে আসেন, একসঙ্গে নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ে ওঠার পর খবরে শুনলাম, ৯ এপ্রিল থেকে আমাদের ডরমিটরি লকডাউন করা হবে। কিছুদিন আগে তিনটা ডরমিটরিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করার পর সেগুলো লকডাউন করা হয়েছে।

পৃথিবীর বহু দেশ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ধর্মীয় উপাসনালয় বন্ধ করে দিয়েছে। সিঙ্গাপুর সরকার শুরু করল একটু দেরিতে। তবে এ দেশের সরকার যেটা মনস্থ করে, সেটা সর্বোচ্চ প্রয়াস দিয়ে করে থাকে। যাহোক, এমনিতেই সবাই আতঙ্কিত ছিল। আমার রুমমেটদের চোখেমুখে এবার স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখতে পেলাম।

রাত সাড়ে ১১টা। ঘুম আসছে না। মুঠোফোনে ডাউনলোড করা কড়ি দিয়ে কিনলাম বইটার পিডিএফ কপি পড়তে শুরু করেছি। তিন ভাগের দুই ভাগ পড়া শেষ হয়ে গেছে আগেই। এখন শেষের অংশটা পড়ছি। পড়তে পড়তে রাত আড়াইটা। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। এমন সময়ে হঠাৎ মুঠোফোনে কল। দেখি মা ফোন করেছেন। তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ছে, ‘বাবা, তুই সুস্থ আছিস তো?’

‘মা, তুমি এখনো ঘুমাওনি? এখন বাংলাদেশে রাত সাড়ে ১২টার বেশি বাজে? রাতে জেগে থেকো না।’

‘তুই এত রাত জেগে কী করছিস?’

‘বই পড়ছি, মা।’

‘তোর এই পাগলামি আর গেল না। অনেক চিন্তা হচ্ছে তোর জন্য!’

‘আমি এখানে অনেক ভালো আছি। নিরাপদে আছি, মা। তোমরা নিজেদের যত্ন নিয়ো। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।’

ফোন রেখে দেওয়ার পর মায়ের জন্য বুকের মধ্যে ব্যথা অনুভব করলাম। হায় রে প্রবাস! মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রিয়জনদের সুস্থতা কামনা করলাম। বালিশে মাথা রাখলাম সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আনন্দ নিয়ে সকালের সূর্য দেখার আশায়।

সাইফ তমাল, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, কেপেল শিপইয়ার্ড লিমিটেড, সিঙ্গাপুর