বিশ্বের খোলনলচে বদলানোর ক্ষমতা নেই করোনার

চলমান সংকটে দৃশ্যমান হয়ে ওঠা সরকারগুলো ভবিষ্যতে তার প্রভাববলয় আরও বাড়াবে। ছবি: রয়টার্স
চলমান সংকটে দৃশ্যমান হয়ে ওঠা সরকারগুলো ভবিষ্যতে তার প্রভাববলয় আরও বাড়াবে। ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে। আর তা হলো এই সংকটের পর কি সবকিছুই বদলে যাবে? সত্যি কথা বলতে এমন প্রশ্নের উত্তরে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলার উপায় নেই, সময়ও এখনো আসেনি।

তবে অনেকেই একে চেনা যুগের সমাপ্তি এবং নতুন যুগের শুরু হিসেবে দেখছেন। অনেকে আবার বলছেন করোনাভাইরাস একটি গোটা যুগের সমাপ্তি নয়, বরং ইতিহাসের গতি বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করবে।

২০০১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হলো, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা, তখনো এমন নানা অনুমানগুচ্ছ এসে ভিড় করেছিল। হতাশাবাদীদের অনেকে তো বলেই বসল যে, ‘আমাদের হাসি-আনন্দের দিন শেষ।’ কিন্তু সত্য হচ্ছে, এরপরও পৃথিবী এগিয়েছে, মানুষের সমাজে হাসিও ছিল, আনন্দও ছিল। আজকের এই অবরুদ্ধ বিশ্বেও সেই একই কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।

প্রতিটি সংকটেরই একটি নিজস্ব প্রকৃতি থাকে, যা ইতিহাসের চাকাকে গতিশীল করে পরিবর্তন ভাবনাটিকে বাস্তবে অনূদিত করে। আবার কিছু সংকট অভাবিতভাবে সব বদলে দেয়। গত শতকের দুটি বিশ্বযুদ্ধই যেমন রাষ্ট্র ও বিশ্বকাঠামো সবকিছুই পাল্টে দিয়েছিল। এই পাল্টে যাওয়াকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, যেকোনো বৈশ্বিক বিন্যাস নতুন কোনো বড় ঘটনায় ওলট-পালট হওয়ার আগপর্যন্ত কাজ করে। ‘ওয়ার্ল্ড ওর্ডারস’ শিরোনামের বইয়ে এই মত ব্যক্ত করেছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। এ জায়গা থেকেই নানা আলোচনা চলছে।

এ বিষয়ে মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটাদাগে বৈশ্বিক বিন্যাস খোলনলচে বদলে দেওয়ার মতো ক্ষমতা মহামারির নেই বলেই মনে করা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, জি-২০, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলো যেভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া মনোভাব দেখাচ্ছে, তাতে অন্তত তেমনই মনে হচ্ছে। কারণ, বৈশ্বিক এ সংকট সামাল দিতে না পারলে রীতি অনুযায়ী কাঠামো টিকিয়ে রাখা এই সংস্থাগুলোও তো অস্তিত্বের সংকটে পড়ার কথা। তাই এই সংকটের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে বড় কোনো পরিবর্তন হয়তো হবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা হ্রাস, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিপরীতে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরও অবনমনের মতো বিষয়গুলো ঘটতে থাকবে।

এই সংকট ব্যক্তিকেই আরও বেশি প্রান্তিক করে তুলবে। জাতীয়ভাবে আরোপিত অবরোধ (লকডাউন) এক নতুন অভিজ্ঞতা, যা ব্যক্তিকে আক্রান্ত করছে সবচেয়ে বেশি। এরই মধ্যে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি অনেক বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। সংকট পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি এর প্রতিক্রিয়া দুভাবে দিতে পারে। প্রথমত, ব্যক্তি আরও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে রাষ্ট্রের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি নিজের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সমাজের সবার বিষয়ে মনোযোগী হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক চরিত্র সময়ের সঙ্গে গৌণ হয়ে উঠবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির খুব দ্রুত পতন ঘটছে। বিশ্বায়নের কারণে সব দেশ পরস্পর সংযুক্ত হওয়ায় এই পতন থেকে আদতে কেউ সুরক্ষিত নয়। ফরেন পলিসি বলছে, এমন পরিস্থিতি গোটা অর্থনৈতিক কাঠামোকে যদি বদলে না–ও দেয়, বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেবে। অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল বদল হবে না—এমন ধারণার জ্বালানিটি দিচ্ছে গত শতকের স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮ সালের সেই মহামারিতে সারা বিশ্বের পাঁচ কোটি মানুষ মারা পড়লেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় তেমন কোনো বদল আনেনি।

তবে চলমান সংকট এরই মধ্যে সারা বিশ্বের মানুষকে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যা বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। আর এই প্রশ্নই দেশগুলোকে এক নতুন বাস্তবতায় নিয়ে দাঁড় করাতে পারে। কারণ, মহামারি মন্দার জন্ম দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফল ছিল গত শতকের প্রথম বৈশ্বিক জোট গঠন। মন্দার কারণেই সে সময়ের মানুষ ও প্রশাসন অবাধ বাজার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায়। বাজারের ব্যর্থতার জেরে রাষ্ট্র সেখানে নাক গলায় এবং সেই ভূমিকা থেকে রাষ্ট্র কখনো পুরোপুরি সরে আসেনি।

মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স যে নর্ডিক মডেলের কথা বলেন, তার জন্ম ১৯৩৮ সালে। দীর্ঘদিনের বেকার সমস্যা ও শ্রম অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনায় রাজি হলে এই ব্যবস্থার জন্ম হয়। এমন কোনো পরিবর্তনের দেখা মিলতে পারে এবার। কিন্তু পুরো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়াটা হয়তো সম্ভব হবে না।

চলমান সংকটে প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজ ক্ষমতা অনুসারে ভূমিকা রাখছে। ‘আরও রাখতে পারত’ বা ‘দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যেত’ ছাড়া মোটাদাগে তেমন গুরুতর সমালোচনা নেই। সংকটে রাষ্ট্রের দিক থেকে আসা এই সাড়া বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়ে জনপরিসরে সম্মতি উৎপাদন করছে। একই সঙ্গে এটি বিদ্যমান কাঠামোবিরোধী মতবাদগুলোকেও খারিজ করে দিচ্ছে অনেকটা। এই সময়ে মার্গারেট থ্যাচার-রোনাল্ড রিগ্যান যুগের মতোই একটি কথা বারবার ঘুরে ফিরে উচ্চারিত হচ্ছে—‘সরকার এখন আর সংকট নয়, বরং সমাধান।’

এই যে সোজাসাপ্টা অনুসিদ্ধান্ত টানা হচ্ছে, এটিই ভবিষ্যতে শক্তিশালী সরকারব্যবস্থার পত্তনের ভিত্তিভূমি হয়ে উঠতে পারে। যদিও সমাধানদাতা সরকার হিসেবে সু-সরকারের কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু এর অর্থ হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিষয়টিকে। অথচ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সরকারের শীর্ষে কর্তৃত্ববাদী দুজন নেতা বসে থাকলেও দেশ দুটোয় মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, সুইডেনের মতো দেশগুলো সংকট মোকাবিলায় যে সাফল্য পেয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছে কার্যকর ও নির্দলীয় প্রশাসন এবং প্রয়োগবাদী শাসনব্যবস্থা।

শেষোক্ত এই দেশগুলো সুশাসন ও কার্যকর সরকার ব্যবস্থার সুফলের বিষয়টি সামনে আনছে, যার কু-ব্যাখ্যা হওয়াটা অসম্ভব নয়। ফলে কার্যকর সরকার বলতে শক্তিশালী সরকারের বিষয়টিই সামনে চলে আসতে পারে। এটি হতে পারে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মধ্য দিয়েই। আজকের মানুষের জন্য ভয়াবহ বিপদ হয়ে দেখা দেওয়া বড় করপোরেশনগুলোর ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াসে সরকারগুলো এ ধরনের হস্তক্ষেপ শুরু করতে পারে, যা তার বিস্তৃতি বাড়াবে। ছোট ও নীতি প্রণয়নসংক্রান্ত কাজে আবদ্ধ থাকা ছোট সরকারের ধারণা বদলে বিস্তৃত ও ক্ষমতাধর সরকারব্যবস্থার পত্তন হতে পারে আবার। আর এটি উন্নয়নশীল কিংবা এরই মধ্যে ভঙ্গুর গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে চলমান দেশগুলোয় শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির ওপরও আরোপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় ও শক্তিশালী সরকার কাঠামোগুলো সাধারণ মানুষের আরেক যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠবে হয়তো।