করোনায় মৃত্যুঝুঁকির সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক আছে?

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে লকডাউনের কারণে বায়ুর মান বাড়ছে বলে বলা হচ্ছে। গবেষকরাও দাবি করছেন, বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হারের একটা সম্পর্ক আছে। মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে গল্পের ছবিটি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে লকডাউনের কারণে বায়ুর মান বাড়ছে বলে বলা হচ্ছে। গবেষকরাও দাবি করছেন, বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হারের একটা সম্পর্ক আছে। মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে গল্পের ছবিটি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে মৃত্যুঝুঁকির সঙ্গে বায়ুদূষণের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন গবেষকেরা। অন্তত দুটি গবেষণা বলছে, উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের ফলে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সেসব অঙ্গরাজ্যে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার বেশি, সেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা ও পিএম২.৫ এর মতো বায়ুমণ্ডলীয় বায়ুকণা যেখানে বেশি, সেখানে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার বেশি। প্রসঙ্গত পিএম২.৫ এমন একটি বায়ুকণা, যা ব্যাসের দিক দিয়ে মানুষের চুলের ৩০ ভাগের এক ভাগ। এটা আগে থেকেই প্রমাণিত যে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে এই বায়ুকণার সম্পর্ক আছে।

হার্ভার্ডের এই গবেষণার এখনো পর্যালোচনা হয়নি। তবে লুডইগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের মহামারি অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনেতো পিটার্স বিবিসিকে বলেন, 'বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সম্পর্ক থাকতে পারে, এমন একটি গবেষণা অনুমান (হাইপোথিসিস) নিয়ে আমরা কাজ করছি।'

এই গবেষণাকর্মের একজন লেখক অধ্যাপক ফ্রান্সিসকা ডমেনিকি বলেন, মহামারির এই সময়ে লোকজনের চলাচল কমে যাওয়ায় অনেক দেশেই বায়ুদূষণ মোকাবিলায় শিথিলতা দেখাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই গবেষণা তাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।

ইতালির ইউনিভার্সিটি অব সিয়েনা ও ডেনমার্কের আরহুস ইউনিভার্সিটির আরেকটি গবেষণায় দেখে গেছে, ইতালির উত্তরাঞ্চলে বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর যোগসূত্র পাওয়া গেছে। ইতালির লম্বার্ডি ও এমিলিয়া রোমাগনা অঞ্চলে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ১২ শতাংশ। এসব এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। অথচ দেশটির বাকি অঞ্চলে এই হার সাড়ে ৪ শতাংশ।

সায়েন্স ডিরেক্ট–এ প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতালির উত্তরাঞ্চলের উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণ করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাড়তি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

ফিলিপাইনের অ্যাসোসিয়েশন ফর রেসপিরেটরি কেয়ার প্র্যাকটিশনার্সের সিজার বুগাইসান বলেন, তাদের দেশে করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তিদের প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এর সঙ্গে বায়ুদূষণের একটা সম্পর্ক আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মারিয়া নেইরা বিবিসিকে বলেছেন, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি, তাদের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। যেসব দেশ বায়ুর মানের ইনডেক্সে তলানির দিকে, সেসব দেশ করোনায় মৃত্যু হারে ওপরের দিকে। তিনি আরও বলেন, 'আমরা বায়ুদূষণে শীর্ষ অবস্থানে থাকা শহরগুলোর একটি ম্যাপ করব। এ কাজে আমরা দেশগুলোর কাছ থেকে তথ্য নেব। এতে করে এসব অঞ্চল এই মহামারি মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারবে।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বিশ্বের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ এমন দেশে বাস করে, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি।

বিশ্বে বায়ুর মান সংক্রান্ত প্রতিবেদন–২০১৯–এ বলা হয়েছে, ভারতের বেশির ভাগ শহরের বায়ুদূষণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ভারতে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ৫২১ জন মারা গেছে।

ভারতের দিল্লির প্রাইমাস সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের এস কে ছামব্রা বলেন, বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনাভাইরাস বিস্তারের সম্পর্ক যদি সত্যিই থাকে, তবে তা হবে ভয়ানক। তবে চিকিৎসা পেশার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটোর মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি এখনই প্রমাণ করার মতো পরিস্থিতি হয়নি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চের রজণীকান্ত শ্রীবাস্তব বলেন, বায়ুদূষণ ও করোনাভাইরাসে মৃত্যু হারের মধ্যে সম্পর্ক থাকার যথেষ্ট প্রমাণ নেই। এ ধরনের গবেষণা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই।

২০০২ সালে সার্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২৬ দেশের ৮ হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়, মারা যায় ৮০০ জন। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনির্ভাসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় দাবি করা হয়, বায়ুদূষণের মাত্রা যেখানে বেশি, সার্স ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সেখানে অন্য জায়গার চেয়ে দ্বিগুণ ছিল।