পুতিনের ক্ষমতার পরীক্ষা নিচ্ছে করোনা

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন চলছে রাশিয়ায়ও। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান অ্যান্ডারসন ক্যাফে। করোনার কারণে এটি এখন বন্ধ। ভয়াবহ সময় পার করছেন এর মালিক। তবে এই কঠিন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য পৌঁছায়নি তাদের হাতে।

আর তাই এর মালিক অ্যানাস্তাশিয়া তাতুলোভার যখন সুযোগ হলো প্রেসিডেন্টের মুখোমুখী হওয়ার, তিনি তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি বলেন, 'আমি চাইনি আপনার সামনে কাঁদতে, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। কারণ এটা সত্যিই অনেক বেদনাদায়ক। সহায়তা করার অর্ধ যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে আসলে কিছু হচ্ছে না।'

গত মাসে লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভ্লাদিমির পুতিন। সেই বৈঠকে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান নারী উদ্যোক্তা অ্যানাস্তাশিয়া তাতুলোভা।ওই বৈঠক তাঁর ১২ মিনিটের বক্তব্য রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ।

সম্প্রতি ওই বৈঠকের বিষয়ে তাতুলোভা বলেন, আমি কেবল চাইছিলাম প্রেসিডেন্ট একবার আমার বক্তব্য শুনুন। সরকারি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। আমাদের নিজেদেরই উপায় খুঁজতে হচ্ছে।

সম্প্রতি করোনারভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট ১৯৩০ সালের মহামন্দাকে ছাড়িয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বলার অপেক্ষা রাখে না—এই ঝড়ো হাওয়া রাশিয়ার অর্থনীতির পালেও লাগবে।

দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা পুতিন নিজের ভিন্ন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। সোভিয়েত পরবর্তী বিশৃঙ্খলা থেকে রাশিয়ায় সরিয়ে এনে শৃঙ্খলা ফিরিয়েছেন তিনি।

গত মাসে আরও ১২ বছর ক্ষমতায় থাকতে সংবিধান সংশোধন করেন পুতিন। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ফেডারেশন কাউন্সিলে প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধন অনুমোদন পায়। চলতি সপ্তাহে পুতিন দেশব্যাপী ভোটে বিজয়ী হয়ে সেই ট্রেডমার্ক 'স্থিতিশীলতা' নিয়ে খেলার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে করোনাভাইরাস মহামারির জন্য খুবই বিপজ্জনক হওয়ায় ভোট স্থগিত করা হয়েছে।

গবেষণা সংস্থা মস্কো কার্নেগি সেন্টারের গবেষক আন্দেরি কোলেসনিকভ বলেন, প্রেসিডেন্টের জন্য এখন কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক রাশিয়ান রাষ্ট্র....তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারে না। তারা মানুষকে সাহায্য করতে পারে না...ব্যবসায়ে সহায়তা করতে পারে না। বেশির ভাগ সহায়তা বড় বড় কোম্পানির জন্য করা হচ্ছে, যা রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য জটিল হলেও প্রেসিডেন্টের জন্য নয়। অন্য সব বিষয় একরকম পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।

কোলেসনিকভ বলেন, আমি এই শাসন ব্যবস্থার জন্য বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিতে পারি না। তবে পুতিনের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রেমলিনের মানুষের সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য স্পষ্টতই নতুন কোন বাধা ছিল না। বরং এখন রাজনৈতিক মহল এবং প্রতিবাদকারী ব্যক্তিদের তুলনায় এই মহামারী আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। কারণ ভাইরাসের মতো হতাশা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

গত সোমবার দক্ষিণের এক শহর ভ্লাদিকাভকাজে হাজার হাজার মানুষ লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আঞ্চলিক সরকার যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের জন্য মাত্র ৩ হাজার রুবল অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করছে।

নাস্তিয়া মিখাইলোভা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ২৯ বছর বয়সী এই নারী কিছুদিন আগে চাকরি হারিয়েছেন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, এটি এখন সরকারের বড় ব্যর্থতার মতোই মনে হচ্ছে। আমি আসলেই মনে করি না মানুষকে খুশি রাখার কথা তারা ভাবছে। আমরাই কেবল দুশ্চিন্তায় আছি।

পুতিন বেকারভাতার সুবিধা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন, তবে কেবলমাত্র জীবন-যাপনের স্তরের ওপর ভিত্তি করে। কোম্পানিগুলোকে মজুরি সহায়তা হিসেবে মাসে ১২ হাজার রুবল দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা ইউরোপের দেশগুলোর সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের চেয়ে ঢের কম।

নিজের কর্মীদের বেতন দিতে না পেরে ইয়েকাটারিনবুর্গের একটি চেইন ফিটনেস ক্লাবের মালিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে অনলাইন একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তার অপারগতা প্রকাশ করেছেন। আলেক্সি রোমানোভ এর জন্য পুতিনকে দায়ি করেছেন। তিনি বলতে চান, পুতিন করোনা মোকাবিলার চেয়ে নিজের ক্ষমতা বাঁচাতে সাংবিধানিক সংস্কার করতে বেশি ব্যস্ত।

মানুষের এই অসন্তোষ থেকে বোঝা যায়, বিপাকে আছেন পুতিন। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকবে। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা বাঁচতে না পারলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। বলা যায়, সংবিধান সংশোধন করে নিজের অবস্থান চূড়ান্ত করতে পারলেও করোনা মহামারিই পুতিনের ক্ষমতার পরীক্ষা নিচ্ছে।