জানালাপথে পৃথিবী দেখা

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা । দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected] 

সন্তানের সঙ্গে রাস্তায় ইরানি নারী।  ছবি: লেখক
সন্তানের সঙ্গে রাস্তায় ইরানি নারী। ছবি: লেখক

১৯৬২ সালে র‍্যাচেল কারসন লিখেছিলেন এক নীরব বসন্তের কথা। কীটনাশকের নির্বিচার ব্যবহারে প্রকৃতি কীভাবে মরে যাচ্ছে, তা–ই তুলে ধরেছিলেন তিনি পরিবেশ নিয়ে লেখা বই সাইলেন্ট স্প্রিং–এ। আজকের দুনিয়ার পরিবেশ আন্দোলনের শিকড়ের শক্তি হয়ে আছে বইটি। এবারেও এক নীরব বসন্ত দেখেছি বটে, কিন্তু তার চরিত্র ভিন্ন। এই বসন্তকে প্রায় জনমানুষহীন নীরব ভুতুড়ে করে তুলেছে নতুন করোনাভাইরাস।

করোনার প্রকোপ ঠেকাতে দেশে দেশে সরকার অফিস–আদালত বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষ এখন গৃহবন্দী এবং কার্যত একঘরে। ‘যদি ভালোবাসো, কাছে এসো,’ এ কথা কেউ আর এখন বলেন না। বরং বলছেন, ‘ভালোই যদি বাসো, তবে দূরে দূরেই থাকো!’ 

সবুজের উচ্ছ্বাস আর ফুলের আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকে ইরানের বসন্ত। শীতে ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা বসন্তে ফুলকুঁড়িতে ভরে ওঠে। এখানে পাড়ায়–পাড়ায় আছে অন্তত একটি করে পার্ক। বসন্তে দিনের বেলায় সেগুলোতে মানুষের মেলা বসে যায়। মধ্যরাত পর্যন্ত চলে শিশু আর নারীসহ হরেক মানুষের স্রোত। আহা, আজি এ বসন্তে সে সব পার্ক নীরব। 

তেহরানে বসন্তে বৃষ্টি হয়। কালেভদ্রে শিলাবৃষ্টিও। কদিন আগে বিকেলে একপশলা শিলাবৃষ্টি হয়ে গেল। ছবি তুলতে তেতলা থেকে নিচে নামব। গিন্নি আর দুই ছেলে নামতে দেবেন না। করোনার ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে আছে। আমি যত গলা চড়াই, তারা ততই শীতল স্বরে জবাব দেয়। ছবি তুললাম, জানালাপথে। বাড়ির কাছে একাধিক উদ্যান। ঘরের বাধার বিন্ধ্যাচল ঠেলে কি সেখানে যাওয়া সম্ভব! 

বাইরে বের হতে পারছি না বলে কি ছবি তোলা বন্ধ রাখা যায়? রাস্তায় চলেছে মাস্কপরা মা-শিশু। তুললাম সে ছবি। রুটি কিনে বা বাজার সেরে ফিরছেন কোনো নারী। তোলা হলো সে ছবিও। ২৪ মিলিমিটার লেন্সটি উল্টে ম্যাক্রো ছবি তোলার পরীক্ষাও চলল। আমার এই লেন্সটার বয়স কম নয়। অন্তত ১৯ বছর। কোনো কোনো ছবি বেশ বিমূর্ততার আভাস নিয়ে এসেছে। তারপরও চলছে পরীক্ষা। 

বসন্তে তুষারপাত ইরানে শিলাবৃষ্টির চেয়েও বিরল ঘটনা। করোনার কালে তা–ও হয়ে গেল। এবারও ছবি তুলতে হলো জানালা দিয়েই। তেহরানে বসন্তে কুয়াশা দেখিনি। এবারে তা–ও দেখলাম। শহর বসন্তদিনে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। ছিলাম অফিসে। হাতের কাছে ক্যামেরা না থাকায় ছবি তুলতে পারলাম না। 

অফিসে যাচ্ছি এক দিন পরপর। যাওয়ার আগে হাতে সিনথেটিকের দস্তানা পরে নিই। প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার মুখে গায়ের তাপ পরীক্ষা করা হয়। লিফটগুলোর সামনে জীবাণুনাশকের বোতল রাখা আছে। তা দিয়ে হাত ধুই। বসার জায়গা পরিষ্কার করি। অফিসের কর্মীদের দুটো দলে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। একদল যেদিন অফিসে যায়, অন্য দল সে দিন বাসায় থেকে কাজ করে। কথা বলতে হয় নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। তবে গাড়িতে করে আনা-নেওয়ার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। 

অফিসে ঢোকার সময় ইলেকট্রনিক যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দিয়ে হাজিরা দিতে হয়। করোনার আগ্রাসনের পরই সে যন্ত্র কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। সাইট খুলে ব্যক্তিগত পাতায় ঢুকে অফিসে হাজিরার তথ্য নিজেকে বসাতে হয়। তারপর অনুমোদন দেন নিজ নিজ দপ্তরপ্রধান। এভাবেই চলছে। 

বাসায় ফিরে বাইরের কাপড়চোপড় আলাদা করে ঝুলিয়ে রাখি। তারপর প্রথমেই ঢুকি গোসলখানায়। আগে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে তারপর বাকি সব কাজ। এটিই এখন নিয়মিত অভ্যাস। রাতে শোবার আগে বা সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াই। ভাবি, কবে ইচ্ছে হলেই যেতে পারব বাইরে, পথে বা পার্কে। জানালা দিয়ে নয়, ছবি তুলতে পারব সরাসরি, যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে।