জাপানের করোনা মোকাবিলা: সংখ্যা আড়ালের লুকোচুরি

আমরা অনেকে জাপানে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করছি। তাদের সামনে করোনাভাইরাসের সংখ্যাগত হিসাবের মধ্যে গোলমেলে কিছু নেই। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিনের হিসাব এবং পরিস্থিতির সচিত্র গ্রাফিক ওঠানামা ই-মেইলে দিচ্ছে। এর বাইরে প্রায় প্রতিদিন জাপানের কয়েকটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও টোকিও মেট্রোপলিটন প্রশাসনের সংবাদ সম্মেলনে ঘরে বসে যোগ দেওয়া এবং প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এর ফলে সবকিছুই এখানে খোলামেলা, রাখঢাকের কোনো সুযোগ একেবারেই নেই। তবে তা সত্ত্বেও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে চোখ বুলিয়ে নিলে মনে হয় জাপানকে নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তিতে এরা ভুগছে। 

হয়তো পশ্চিমা গণমাধ্যম মেনে নিতে চাইছে না, জাপানে কেন সবকিছুর হিসাব এতটা কম। ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের হিসাব কম, মৃত্যুর সংখ্যাও একেবারেই নগণ্য। ফলে পশ্চিমের আনুপাতিক হিসাবের সঙ্গে তুলনা করে নিয়ে ধরেই নিচ্ছে যে এটা গ্রহণযোগ্য নয় এবং কোথাও বুঝি রাখঢাক রয়ে গেছে।

এত দিন বলা হচ্ছিল, জাপানের হাসপাতালে শয্যার ঘাটতি করোনা-আক্রান্তদের সংখ্যা আরও বড় হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে হাসপাতালে শয্যার ঘাটতি কিন্তু ভিন্ন এক কারণে। করোনাভাইরাস যে এতটা দাপটের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে চারিদিক লন্ডভন্ড করে দিয়ে এগিয়ে আসবে, সেই ধারণা আগে থেকে কেউ করতে পারেনি। তাই এর জন্য কোনো রকম প্রস্তুতি একেবারেই নেওয়া ছিল না। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার পর ভাইরাস জাপানের দিকে ছুটে আসতে শুরু করলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তখন থেকেই বিকল্প হাসপাতাল সেবা প্রদানের ধারণা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে সরকার।

স্বাভাবিক অবস্থায় হাসপাতালে শয্যার কোনো রকম ঘাটতি জাপানে নেই এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেকটা সমতামূলক। অর্থাৎ টোকিও দেশের রাজধানী হওয়ায় সেরা চিকিৎসা যে কেবল সেখানেই পাওয়া যাবে, তা নয়। দূরের শহরগুলোও চিকিৎসা ব্যবস্থায় একেবারে পিছিয়ে নেই। তবে কথা হচ্ছে, প্রতিটি হাসপাতাল নিয়মিতভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকে এবং নথিবদ্ধ সেই রোগীদের ফেলে রেখে কেবল করোনা-আক্রান্ত রোগীদের সেবায় সবকিছু ছেড়ে দিলে সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি না পেলেও এমনিতেই অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। সেই চিন্তা থেকে টোকিও এবং অন্য কয়েকটি শহরে কিছু কিছু হোটেল পুরোটা ভাড়া নিয়ে হালকা উপসর্গ দেখা দেওয়া করোনা-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকার করছে। এর বাইরে এখন এমনকি পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাওয়া অলিম্পিক ভিলেজকেও অস্থায়ী হাসপাতাল হিসেবে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা সরকারের আছে। তবে এর সবটাই করা হবে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে, সে রকম পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।

হাসপাতাল শয্যার ঘাটতির এই ব্যাখ্যা সমালোচকদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছে কি না, বলা মুশকিল। কেননা সমালোচনা এরা অব্যাহত রেখেছে এবং এখন তা অন্যদিক থেকে। এদের কেউ কেউ এখন বলছে, জাপানে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার পরীক্ষা এতটাই কম যে এর থেকে প্রকৃত অবস্থা বুঝে ওঠা কষ্টকর। জাপান সরকার অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করছে না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে নজর দিলে এত কম পরীক্ষা নিয়ে হাঁ-পিত্যেশ করার কিছু নেই। জাপানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হওয়ার প্রায় দুই মাস পর এখন ১২ হাজারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩০০ জনের মতো। দুই হিসাবই বিশ্বের অন্যান্য অগ্রসর দেশের তুলনায় খুবই কম। করোনার সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার দৈনিক সংখ্যাও এখন অনেকটা সমতল হয়ে আসছে।

আর তাই মোট কতজনের ওপর পরীক্ষা চালানো হলো, তার চেয়ে বরং রোগপ্রতিরোধের স্বাভাবিক যেসব উপায়—যেমন প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়া, বাইরে থেকে এসে হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলা, জীবাণুনাশক স্যানিটাইজার ব্যবহার করে চারদিক জীবাণুমুক্ত রাখা, মাস্ক পরে বাইরে বের হওয়া—এসব দিক সম্পর্কে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করে তোলার দিকে সরকার জোর দিচ্ছে। এর অন্য একটি কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা সময়সাপেক্ষ হওয়া।

জাপানে করোনা শনাক্তের যে প্রক্রিয়া প্রচলিত রয়েছে সেটাকে বলা হয় পলিমেরাস চেইন রিঅ্যাকশন টেস্ট, সুপ্ত থাকা অবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে যেটা সক্ষম। তবে এই পরীক্ষা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এখন পর্যন্ত জাপানে চালানো পরীক্ষার সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ৩০ হাজারের কিছু বেশি। পশ্চিমের যেকোনো দেশ, এমনকি প্রতিবেশীদের চেয়েও যা অনেক কম। দক্ষিণ কোরিয়ায় যেমন ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে, জাপানে সেই ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে পরীক্ষায় ইতিবাচক প্রমাণিত হয়েছে ১২ হাজারের একটু বেশি। আনুপাতিক হিসাবে যা হচ্ছে প্রায় ১০ শতাংশ। তবে এদের সবাই যে মারাত্মকভাবে করোনায় আক্রান্ত, তা নয়। মৃত্যুর নিম্ন হার সেই প্রমাণ দেয়। তবে তা সত্ত্বেও জাপান অবশ্য পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।

তবে যে দুটি দিকের ওপর জাপান অনেক বেশি নজর দিচ্ছে তা হলো রোগের চিকিৎসার ওষুধ এবং প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার। চিকিৎসার ওষুধ আবিষ্কারের বেলায় জাপান বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেও প্রতিষেধক টিকার বেলায় অগ্রগতি মনে হয় তুলনামূলকভাবে কম। তবে সেটাও অচিরেই চলে আসবে বলে অনেকে মনে করছেন। আর জনগণ যদি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উপদেশ মেনে চলেন, তাহলে জাপানে ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের দৈনিক হিসাব সমতল অবস্থা থেকে ধীরে নিচের দিকে নামতে শুরু করবে এবং একসময় তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।

ফলে সংখ্যাগত হিসাবের গোলকধাঁধা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বরং উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অন্যদিকে—কী হবে করোনা-পরবর্তী বিশ্বের অবস্থা? আমরা প্রায় তিন মাস সব ধরনের কাজকর্ম গুটিয়ে নিয়ে ঘরে বসে আছি। এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে গবেষকেরা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছেন। আর অদূর ভবিষ্যতের বিশ্বের আগাম যে ছবি আমাদের সামনে তারা তুলে ধরছেন, তা করোনাভাইরাসের চেয়ে কম ভয়াবহ একেবারেই নয়। বিশ্বজুড়ে দেখা দেওয়া খাদ্যঘাটতি থেকে বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস পাখা বিস্তার করবে, আমরা আবারও হয়তো তলিয়ে যাব এমন এক অজানা বিশ্বে, মৃত্যু আর হানাহানি যেখানে হয়তো হয়ে উঠবে আরও অনেক বেশি নৈমিত্তিক। তেমন অবস্থা যেন না দেখা দেয়, সেটা নিয়ে মনে হয় এখন থেকেই ভাবনাচিন্তা শুরু করা দরকার।
টোকিও, ২৩ এপ্রিল