মানবজাতি কি জিতবে?

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ–বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
অলংকরণ : প্রথম আলো
অলংকরণ : প্রথম আলো


প্রায় ছয় শ বছর আগে চতুর্দশ শতাব্দীতে ব্ল্যাক ডেথ যখন চীনে প্রথম দেখা দেয়, সেই মহামারি ইউরোপ পর্যন্ত আসতে সময় নিয়েছিল প্রায় ১০ বছর। এতে ইউরোপ-এশিয়ার প্রায় ২০ কোটি বা ৩৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের এক লাখ অধিবাসীর মধ্যে মারা যায় ৫০ হাজার। ১৫২০ সালের মার্চে গুটিবসন্ত নিয়ে ইউরোপ থেকে প্রথম নৌকা ভিড় করে মেক্সিকোর পোতাশ্রয়ে। পুরো মেক্সিকোতে সেটি ছড়িয়ে পড়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই। মারা যায় ২০ লাখ মানুষ, বেঁচে থাকে মাত্র ২ লাখ।


এদিকে এবারের করোনাভাইরাস চীন থেকে ইউরোপে আসতে সময় নিয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ। এই উদাহরণ দিয়ে লোকরঞ্জনবাদীরা বলেই চলেছেন দেশে দেশে দেয়াল তোলার কথা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কথা। এই সুযোগে তাঁরা একপ্রস্থ বিশ্বায়নের বিরোধিতাও করে নিচ্ছেন। যারা ‘আমরা আমরা’ ভুলে শুধু ‘আমি আমি’ করে তাদের এখন পোয়াবারো। তারা মোক্ষম যুক্তি পেয়েছে ইতালির ঘটনায়। উত্তর ইতালির যে স্থানে করোনাভাইরাসের প্রথম সূত্রপাত ঘটে সেখানে প্রচুর টেক্সটাইল মিলের কারখানা, চীনের সঙ্গে ওই শহরের ব্যবসা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। চীনের সঙ্গে যদি ইতালি তাৎক্ষণিক সম্পর্ক ছিন্ন করত তবে কি মহামারি আজ এই পর্যায়ে পৌঁছাত?


কঠিন যুক্তি, আপাতত অবশ্যই সঠিক কথা। কিন্তু সুবিধাবাদী রাজনীতিকেরা দেশে দেশে মানুষে মানুষে বিভাজনের এই সুযোগ শুধু করোনাকালেই সীমাবদ্ধ রাখবেন না সেটি বোঝা কষ্টকর নয়। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই বলেছেন, ‘দেয়াল তোলার কথা কেন আমি বারবার বলি তার গুরুত্ব নিশ্চয়ই সবাই এখন বুঝবে।’ কিন্তু যখন মধ্যযুগের ওই প্লেগ চীন থেকে এসে ইউরোপে গণহারে মানুষ মেরেছে তখন বিশ্বায়ন বলতে কিছুই ছিল না, ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল নামমাত্র। কিন্তু তাতে কি মহামারি আটকে ছিল? আজকে ব্রিটেনের দৈনন্দিন শাকসবজি, ডাল ,আটা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের ৩০ শতাংশ যায় ইউরোপ থেকে। বিশ্বায়নের মাত্রা এত দূর হওয়ার পরও এবারের মহামারিতে মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত অতীতের মহামারি থেকে থেকে কম নয় কি? কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও বিশ্বায়নের প্রভাবে মহামারি ছড়াতে তো সময় লাগছে কম। তাহলে বিশ্বায়ন-সমস্যা তো রয়েই যাচ্ছে।



মানুষের ভেতরের সবচেয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য তারা সামাজিক জীব। তারা একে অপরের বিপদে অগ্রগামী হয়, নানা প্রকার সামাজিক অনুষ্ঠানে বহু মানুষের সমাগম ঘটে। ভাইরাসের মতো গোপন এককোষী প্রাণী মানুষের এই অনিন্দ্যসুন্দর আচরণের সুযোগ নেয়। বর্তমান পৃথিবীর মানুষ ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক সামাজিক আর নিবিড় যোগাযোগের ভেতর বাস করে। অবশ্যই এটি বিশ্বায়নের ফল আর এর কারণে যেকোনো ভাইরাস মানবজাতিকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতহারে বিপদে ফেলতে সক্ষম।



কিন্তু ঘটনার বিপরীতেও ঘটনা আছে। ভুলে গেলে চলবে না মানবজাতির ইতিহাসে বিজ্ঞান এই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং এটি শুধু শক্তিশালীই হতে থাকবে, তাসের ঘরের মতো বিজ্ঞানের জয়যাত্রা রোধ হবে না। আশার কথা হলো করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বের করতে বিজ্ঞানীরা সময় নিয়েছেন মাত্র দুই সপ্তাহ। বিজ্ঞান যখন মহামারির কারণ বুঝতে পারে তখন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ হয়ে যায়।
১৯৬৭ সালেও গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয় ১৫ লাখ মানুষ, মারা যায় ২ লাখ। কিন্তু এর ভ্যাকসিনের ব্যাপক প্রচার ও প্রয়োগের ফলে ১৯৭৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করে, মানবজাতির জয় হয়েছে কারণ বসন্তরোগ সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়েছে। ২০১৯ সালে পৃথিবীর কোথাও একটি মানুষের মৃত্যু তো দূরের কথা, বসন্ত রোগে একটি মানুষ আক্রান্তও হয়নি।


বিজ্ঞানের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া বিশ্ব আর কী কী করতে পারে? এই মুহূর্তে পৃথিবীর দরকার সঠিক দক্ষ নেতৃত্ব আর বৈশ্বিক সংহতি। ২০১৪ সালের ইবোলা আক্রমণে যখন পশ্চিম আফ্রিকা পর্যুদস্ত, ইতিহাসবিদ ইউভাল হারারি ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’–এ লিখেছেন, তখন পৃথিবীতে পরিপক্ষ নেতৃত্ব ছিল যারা ওই মহামারিতে প্রজ্ঞাসুলভ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে পৃথিবীর অক্ষ ঘুরে গেছে। আমেরিকা নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করেছে। এই নেতৃত্ব মনে করে পৃথিবীর প্রতি তাদের কোনো দায় নেই, তাদের আছে শুধু ‘স্বার্থ’ (Interest)। আমরা দেখতে পেলাম কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই আমেরিকা ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল, তবে ব্রিটেন বাদে। করোনার ভ্যাকসিনের ওপর একক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জার্মানির একটি ফার্মাসিউটিক্যালসকে এক বিলিয়ন ডলার অফার করেছিল তারা।


এত কিছুর পরও যদি আমেরিকা আজকের মহামারি থেকে উদ্ধারে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে আসতে চায়, বাকি বিশ্ব কি এমন একটি দেশকে বিশ্বাস করতে চাইবে যে দেশের প্রশাসন কোনো কিছুর দায় নিতে চায় না। যারা ভুল স্বীকারকে দুর্বলতা মনে করে, নিয়মিতভাবে সব দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে নিজেরা শুধু বাহবা নিতে ইচ্ছুক এবং যাদের প্রধান মোটো হলো ‘মি ফার্স্ট’?


নেতৃত্বের এই খড়াকালেই আরেক বিপদ আমরা দেখতে পারছি। মানুষ যে আসলেই ‘মানুষ’, তা প্রমাণ করার সময় সকালে–বিকেলে আসে না, তা আসে কালেভদ্রে। দুর্যোগের সময় ভবিষ্যৎ বিপদের কথা ভেবে পৃথিবীব্যাপী মানুষের ক্রোধ, লোভ, ভোগবাদিতার উগ্র রূপ ধরা পড়েছে। সুপারশপে খালি তাকের দিকে বৃদ্ধদের তাকিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের এই রূপকে প্রকাশিত করেছি। কিন্তু বিপদের এই সময়ে আমাদের প্রয়োজন আরও বেশি বৈশ্বিক সংহতি আর সহমর্মিতা। জার্মানি নিজে বিপদে থেকেও সম্প্রতি ইতালি এবং ফ্রান্স থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত কয়েকজন গুরুতর রোগী নিজেদের বিমানে উড়িয়ে এনে চিকিৎসা দিচ্ছে। পৃথিবীর এই মুহূর্তে এটিই সবচেয়ে বেশি দরকার।
মানুষের কোনো বিপদই মানুষের বিবর্তনকে রুখে দিতে পারেনি। মানুষ বিবর্তনের ধারা বেয়ে আজকে পৃথিবী শাসন করছে, তারা ঘোষণা করেছে ‘মানুষই’ শ্রেষ্ঠ। এই মানুষেরই রয়েছে অসীম ভালোবাসার ক্ষমতা। বাংলাদেশের আনাচকানাচে আজ তরুণেরা মানুষের সাহায্যার্থে পথে নেমেছেন। মহাবিপদের এই দিনে মানবজাতিকে জয়ী হতে গেলে তাই ভালোবাসার মতো অপূর্ব এই ক্ষমতার কথা ভুলে গেলে চলবে না।


*লেখক : জার্মানিতে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স, বার্লিনের এক প্রতিষ্ঠানে রোবটিকস অটোমেশনে কর্মরত। [email protected]