করোনার টিকা উৎপাদনে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ভ্যাকসিন ছাড়া কোভিড-১৯-এর হাত থেকে সম্ভবত মানবজাতি পুরোপুরি রেহাই পাবে না বলে মনে করেন বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন বিল গেটস। তাঁর প্রতিষ্ঠানসহ অনেক দেশ ও কোম্পানি এখন ভ্যাকসিন বানানোর চেষ্টা করছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, এই প্রতিযোগিতায় শত শত কোটি ডলার ব্যয় করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

টিকা বা ভ্যাকসিন দ্রুত বাজারে নিয়ে আসার জন্য এই কোম্পানি ও দেশগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্রুতগতিতে করছে। বিধিসম্মত পর্যবেক্ষণের সময়ও কমিয়ে এনেছে তারা। কিন্তু এসব যে সফল হবে, তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই। এরা টিকার ক্রয়াদেশ দিচ্ছে, কিন্তু সেই টিকা উৎপাদিত হবে, এমন সম্ভাবনা কম।

জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পল স্টোফেলস রয়টার্সকে বলেন, ‘এই সংকটের পরিসর এত বড় যে এখন আমাদের সবাইকে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে হবে।’ জনসন অ্যান্ড জনসন এই টিকা উদ্ভাবনে মার্কিন সরকারের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। পল বলেন, এখন যদি এই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়, তাহলে ব্যাপারটা সবার জন্যই খুব খারাপ হবে।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, টিকা উৎপাদনের চেষ্টায় ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সফলতা আসে। এর জন্য বহু বছরের সাধনা প্রয়োজন হয়। আর গবেষণা সফল হবে এমন সম্ভাবনা দেখা গেলেই বড় বড় কোম্পানি তাতে বিনিয়োগ করতে আসে। কিন্তু করোনাভাইরাস সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়েছে। তা আবার হবেই না বা কেন, এই রোগে যে এখন পর্যন্ত ২৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। বিপর্যস্ত হয়েছে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি। তাই দেখা যাচ্ছে, ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে এই রোগের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কোটি কোটি ডোজ উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

সে জন্য সরকার, ওষুধ কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা অভূতপূর্ব উপায়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। ওষুধ কোম্পানি থেকে শুরু করে এই খাতসংশ্লিষ্ট ৩০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তাঁরা জানিয়েছেন, ঝুঁকি নেওয়াটা জরুরি। কারণটা হলো, এই টিকা উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে তা যেন উৎপাদন করা যায়, সেটাও জরুরি।

পৃথিবীতে এখন করোনাভাইরাসের শতাধিক টিকা তৈরিতে সরকার, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগোষ্ঠী ও মানবতাবাদীরা বিনিয়োগ করেছেন। এগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি মানুষের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে পৌঁছেছে। আর এই পর্যায়েই অধিকাংশ টিকা বাতিল হয়ে যায়। এমনকি যেগুলো সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়, তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি টিকা সফল হয়। ফলে একাধিক টিকা যেমন কার্যকর হতে পারে, তেমনি আবার কোনো টিকা কার্যকর না–ও হতে পারে, সেটাও সম্ভব।

যেসব কোম্পানি এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তাদের কিছু সুবিধা আছে। এতে একদিকে যেমন তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, তেমনি টিকা প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কিছু অগ্রগতি হচ্ছে। জনসন অ্যান্ড জনসন ও গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের মতো কিছু কোম্পানি অবশ্য বলছে, তারা উৎপাদনের খরচেই এই টিকা বাজারে ছাড়বে। তবে ভবিষ্যতে এটি মৌসুমি টিকা হয়ে উঠলে তখন এরা ব্যাপক মুনাফা করতে পারবে।

তবে টিকা উদ্ভাবিত হলেও তা যদি উৎপাদন ও বিতরণের সুযোগ না থাকে, তাহলে তেমন ভালো কিছু হয় না। সে জন্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করাও জরুরি।
অভূতপূর্ব গতিতে টিকা উৎপাদন

করোনাভাইরাসের টিকা যে গতিতে উৎপাদিত হচ্ছে, ইতিহাসে তার নজির নেই। দাতাগোষ্ঠী ও সরকারের সমন্বয়ে গঠিত কোয়ালিশন ফর এপিড্রেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের (সিইপিআই) নামের একটি জোটের তথ্যমতে, এখন করোনাভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনে ১১৫টি প্রকল্প চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় থেকে উৎপাদন—সব ক্ষেত্রেই সাধারণত যে সময় লাগে, এই টিকার ক্ষেত্রে সেই রকর্ড ভেঙেচুরে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা হচ্ছে, হাজারখানেক মানুষের ওপর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানোর পরই কেবল সাধারণের ওপর এটি প্রয়োগ করা হয়। সুইডেনের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব বের্নের রোগ প্রতিরোধ বিভাগের প্রধান মার্টিন বাকম্যান রয়টার্সকে বলেন, ছোট একটি গোষ্ঠীর ওপর এই টিকা প্রয়োগ করে নিশ্চিত হতে হবে যে এটি বিষাক্ত নয়। এরপর সুইডেনের গবেষকেরা আগামী ছয় মাসে বিপুলসংখ্যক নাগরিককে এই টিকা দেবেন। এরপরই কেবল বিশ্ববাজারের জন্য উৎপাদন করা হবে।

অন্যান্য দেশের টিকা গবেষকেরাও এই স্বল্প পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গণহারে এই টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার মায়ো ক্লিনিকের গবেষক গ্রেগরি পোল্যান্ড রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি মনে করি না, এভাবে একটি টিকা বাজারে ছাড়া যায়।’
শিক্ষা না নেওয়া

কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে চলমান এই লড়াইয়ে আরেকটি লড়াইয়ের ছায়া পড়েছে। এর আগে ২০০৯ সালের বসন্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতে সোয়াইন ফ্লুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আখ্যা দেয়, ১৯৬৮ সালের পর যা এই প্রথম।

তখন যেসব ধনী দেশের টিকার বাজারের সঙ্গে সাময়িক চুক্তি ছিল, তারা সবাই সেটা ব্যবহার করে। তারা কার্যত এই বৈশ্বিক টিকা সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর একচেটিয়া অবস্থা কায়েম করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ২৫ কোটি টিকার ক্রয়াদেশ দেয়। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন—সবার হাতেই তখন টিকা ছিল।

এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চাপে পড়ে এই দেশগুলো গরিব দেশগুলোর সঙ্গে তাদের মজুতের ১০ শতাংশ ভাগাভাগি করতে রাজি হয়। কিন্তু উৎপাদন ও বিতরণে সমস্যার কারণে মাত্র ৭ কোটি ৭০ লাখ টিকা অন্যান্য দেশে যায়। প্রয়োজনের চেয়ে যা ছিল অনেক কম। তা–ও আবার অনেক দেশে রোগ চূড়ান্ত জায়গায় যাওয়ার পরই টিকা পেয়েছে তারা। এবারও সে রকম কিছু হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গত শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিকা উৎপাদন দ্রুততর করতে অভাবনীয় সহযোগিতার ডাক দেয়। এই প্রক্রিয়ায় তারা ৮০০ কোটি ডলার তোলার ঘোষণা দেয়। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ তাতে সাড়া দেয়। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম দুই শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটাই ভয়ের কারণ।