কোভিড-১৯ আক্রান্ত পুরুষদের ঝুঁকি কমাতে নারী হরমোনের প্রয়োগ

কোভিড–১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়া নারীদের চেয়ে পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করেই এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ অবস্থায় নারীদের প্রজনন হরমোনের কোনো ভূমিকা রয়েছে কিনা এবং আক্রান্ত পুরুষদের রক্ষায় এটি কোনো কাজে আসতে পারে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। এরই মধ্যে এ সম্পর্কিত দুটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে প্রথম কোভিড–১৯ এর প্রকোপ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত রোগটিতে পুরুষেরাই বেশি মারা গেছে। লস অ্যাঞ্জেলেসর সিডারস–সিনাই মেডিকেল সেন্টারের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকা কোভিড–১৯ রোগীদের ৭৫ শতাংশই পুরুষ। অন্য হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রেও অনুপাতটি কাছাকাছি রকমেরই।

এ ক্ষেত্রে এনপিআরের একটি প্রতিবেদনের দিকে তাকালে অনুপাতটি আরও স্পষ্ট হবে। এতে বলা হয়, এপ্রিলের শুরুর দিকে নিউইয়র্ক নগরীতে মারা যাওয়া নারীদের চেয়ে মৃত পুরুষের সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। সেখানে অবশ্য এর কারণ হিসেবে পুরুষদের মধ্যে মদ্যপান ও ধূমপানের মতো অভ্যাস বেশি থাকা এবং বাইরের দূষিত বাতাসে বেশি সময় থাকার কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই পুরুষের চেয়ে শক্তিশালী থাকে।

আর এই শেষোক্ত তথ্যটিই বিজ্ঞানীদের সামনে এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেন। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হরমোন এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি নিঃসৃত করে, যা তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। এ দুটি হরমোনকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নারীর এই রোগে বেশি সুরক্ষিত থাকার কারণ। কেননা এই দুটি হরমোন সংক্রমণ ও এর বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে আসা ক্ষতিকর সাড়া – দুই থেকেই নারী শরীরকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করে।

এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের এই বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রেখে সিডারস–সিনাই মেডিকেল সেন্টার ও স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনেসাঁ স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকেরা কিছু কোভিড–১৯ রোগীকে নিয়ে গবেষণাটি শুরু করেন। এই রোগীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন প্রয়োগ করে তাঁরা দেখতে চান, এই হরমোনের উপস্থিতি সংশ্লিষ্ট রোগীদের ওপর কোনো প্রভাব রাখতে পারে কিনা।

আজ মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠানের দুই গবেষকের ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এতে রেনেসাঁ স্কুল অব মেডিসিনের শল্যবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আন্তোনিও গাসপারিস বলেন, 'এমনও কিছু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০ শতাংশই পুরুষ। বাকি ২০ শতাংশ নারী। এ কারণেই এস্ট্রোজেনের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করি।'

এ ক্ষেত্রে এস্ট্রোজেন কীভাবে কাজ করে, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণার প্রধান শ্যারন নাচম্যান সিএনএনকে বলেন, 'বিষয়টি সম্পর্কে আমরা এখনো পরিষ্কার নই। আমরা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এটি প্রয়োগ করেছি। কিছু সুফল দেখা যাচ্ছে। এ সম্পর্কিত পূর্ববর্তী গবেষণা আমাদের বলছে যে, এস্ট্রোজেন শরীর থেকে ভাইরাস অপসারণে এবং ভাইরাসের কারণে হওয়া ক্ষত সারিয়ে তুলতে সহায়তা করে।'

এই হরমোন শুধু পুরুষের শরীরে নয়, মেনোপজ পরবর্তী নারীদের শরীরেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। যেহেতু মেনোপজপরবর্তী সময়ে নারীদের মধ্যেও এস্ট্রোজেনের ক্ষরণ কমে আসে, তাই স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী পুরুষদের পাশাপাশি ৫৫ বছর ও তদূর্ধ্ব নারীদেরও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে সেখানে ১১০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালানো হবে, যাদের শরীরে এখন পর্যন্ত একটির বেশি গুরুতর উপসর্গ দেখা যায়নি। অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের ত্বকে এস্ট্রোজেনের প্যাচ (পট্টি) এক সপ্তাহের জন্য লাগানো থাকবে এবং বাকি অর্ধেককে প্রচলিত চিকিৎসা দেওয়া হবে।

এদিকে সিডারস–সিনাই মেডিকেল সেন্টারে পরিচালিত গবেষণায় রোগীদের ওপর প্রোজেস্টেরন প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রোজেস্টেরনের যেহেতু প্রদাহরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাই গবেষকেরা এই হরমোনটির দিকেও বিশেষভাবে মনোযোগী।

এ বিষয়ে সিডারস–সিনাই মেডিকেল সেন্টারের আইসিইউ চিকিৎসক সারা ঘান্দেহারি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত কোভিড–১৯ রোগীদের মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর হয়েছে, বা যারা মারা গেছে, তাদের অধিকাংশই পুরুষ। এ বিষয়টি বিস্ময়কর। এ কারণেই সবাই সেক্স হরমোনের ভূমিকার বিষয়ে মনোযোগী হয়েছে। গর্ভাবস্থায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন ক্ষরণ বেশি হয়। ফলে কোভিড–১৯ আক্রান্ত হলেও গর্ভবতীদের মধ্যে এ রোগ প্রকট হয় কম। এর অর্থ হচ্ছে, নারী হওয়াটা বা গর্ভধারণ করাটাই একটা সুরক্ষা হিসেবে কাজ করছে। আর এটিই আমাদের হরমোন নিয়ে গবেষণা শুরুর কারণ।'