ভ্যাকসিন না পেলে কী হবে

কোভিড–১৯ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব। ছবি: রয়টার্স
কোভিড–১৯ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব। ছবি: রয়টার্স

একটি ভাইরাসের বিস্তার সারা বিশ্বকে রীতিমতো থমকে দিয়েছে। নতুন এ করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউন বা অবরোধের পদক্ষেপ নিয়ে স্থবির হয়ে আছে। বিভিন্ন দেমের শাসকেরা একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় রয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো সেই সুসংবাদ দেওয়ার চেষ্টায় নানা তত্ত্ব–তালাশ করছে। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত ৯০টির বেশি ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও এর একটিও এখনো নিশ্চিত নয়।

বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী, তহবিলদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরে সবাই একটি প্রশ্নই বারবার করে করছে। আর তা হলে—একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে কত দিন লাগতে পারে? উত্তর মোটাদাগে একটিই আসছে—১৮ মাসের আগে নয়। বিশ্ববাসী অনেকটা শ্বাসরুদ্ধ করে সেই ১৮ মাসের দিকে তাকিয়ে আছে। শাসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার কাছেই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একটি মাত্র দরজা হিসেবে হাজির হয়েছে 'ভ্যাকসিন'। এই শব্দটি উচ্চারণে বা এর প্রচারেই যেন অনেকে অনেকটা স্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, যথাযথ ভ্যাকসিনটি পাওয়াই গেল না, তবে কী হবে?
এমন তো হতেই পারে যে, নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ও নিরাপদ টিকা বা ভ্যাকসিনের দেখা পেলই না মানুষ। তখন কী হবে? উত্তর সোজা—মানুষকে তখন এই ভাইরাসের সঙ্গেই বাস করার কৌশল আয়ত্ব করতে হবে। সহাবস্থানের পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। নিজের শরীরকে, নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো ভ্যাকসিনের দেখা না পেলেও ধীরে ধীরে সব খুলে দিতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব বন্ধ রাখা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে খুব দ্রুতই হয়তো বিভিন্ন শহর খুলে দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থদের আইসোলেশনে রাখার নীতি নেওয়া হতে পারে। অবশ্য ভ্যাকসিন না পেলেও চিকিৎসা পদ্ধতির দেখা দ্রুতই পাবে মানুষ। ফলে মৃত্যুহার কমে আসবে। তবে বাজে বিষয় যেটি হবে, তা হলো ভ্যাকসিন তৈরি না করতে পারলে প্রতি বছরই ভাইরাসটি ফিরে ফিরে আসবে, যা কোনো কোনো বছর এমনকি মহামারি আকারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিভিন্ন দেশের শাসক, গবেষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা বারবার সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে ভ্যাকসিনের কথা বলছেন। সারা বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে আছে ভ্যাকসিন তৈরি সম্পর্কিত একটি সুখবরের দিকে। কিন্তু যে কথাটি বলা হচ্ছে না, তা হলো ভ্যাকসিনের দেখা তো নাও মিলতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তুতি কী হবে? যেহেতু এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে, তাও একাধিকবার, সেহেতু বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুত থাকাটা তো জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড–১৯ বিষয়ক বিশেষ দূত ও ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্লোবাল হেলথের অধ্যাপক ড. ডেভিড নাবারো সিএনএনকে বলেন, 'এমন কিছু ভাইরাস রয়েছে, যেগুলোর প্রতিহতে আমাদের হাতে কোনো টিকা নেই। তাই আমরা এটা চোখ বুজে ধরে নিতে পারি না যে, আমরা একটি ভ্যাকসিনের দেখা শেষ পর্যন্ত পাব।'' সে ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ ও অঞ্চলেরই নিজেদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি যেন, তারা একটি স্থায়ী হুমকি হিসেবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যোগ্যতা অর্জন করে। এই ভাইরাসের অস্তিত্ব স্বীকার করেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন শুরুর কৌশল নিয়ে তার ভাবা উচিত।'
তবে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করছেন যে, কোভিড–১৯ এর ভ্যাকসিন দ্রুত তৈরি করা যাবে। এই ভাইরাস যেহেতু এইচআইভি ও ম্যালেরিয়ার মতো দ্রুত নিজের রূপের বদল ঘটাতে পারে না, তাই একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের দেখা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিমেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসির মতো অনেক বিশেষজ্ঞই একটি কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিনের জন্য ১২–১৮ মাস সময় লাগবে বলে আসছেন। আবার ইংল্যান্ডের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ক্রিস হুইটি বলছেন, প্রাক্কলিত এই সময়সীমা অনেক ছোট। এর চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেইলর কলেজ অব মেডিসিনের ন্যাশনাল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিন ড. পিটার গোটেজ সিএনএনকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত এত অল্প সময়ে আমরা কোনো ভ্যাকসিন হাতে পাইনি। এর অর্থ এই নয় যে, এটি অসম্ভব। কিন্তু এটি করাটা হবে একেবারে অভাবিত ঘটনা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের হাতে একাধিক পরিকল্পনা থাকা উচিত।'

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৮৪ সালে মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিষয়ক মন্ত্রী মার্গারেট হেকলার ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিজ্ঞানীরা একটি ভাইরাস শনাক্ত করেছেন। এটি প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দু বছরের মধ্যে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা যাবে।

মার্গারেট হেকলার কথিত সেই ভাইরাসটির নাম এইচআইভি। শনাক্তের পর প্রায় চার দশক চলে গেছে। ভাইরাসটি কেড়ে নিয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ। আর বিশ্ব এখনো এর প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাটি তৈরি করেছে এইচআইভি নিজেই। ইনফ্লুয়েঞ্জা জীবাণু একেক বছর একেক রূপ নিয়ে হাজির হয়। যে বছর যে, রূপটি থাকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নিলেই চলে। কিন্তু এইচআইভির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এটি মানুষের শরীরের মধ্যেি নিজের রূপ বদলাতে সক্ষম। ফলে এর প্রতিরোধে শরীরের অভ্যন্তরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর কিছু করতে পারে না। একটি মাত্র জীবাণুর সংক্রমণ হলেও এর ধরনটি এমন যে মনে হয়, এইচআইভির হাজারো ধরন সক্রিয় রয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, কোভিড–১৯ এইচআইভির মতো নয়।
কিন্তু শুধু এইচআইভিই নয়। এখনো মানুষ কোনো টিকা তৈরি করতে পারেনি এমন রোগের মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের ৪ লাখের বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। ২০১৭ সালে এর একটি টিকা তৈরি করা হয়। বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখা গেল, এটি রোগটিকে আরও জটিল করে তোলে, তখন তা বাতিল করা হয়। একইভাবে রিনোভাইরাস ও অ্যাডেনোভাইরাসেরও কোনো টিকার দেখা মেলেনি সেভাবে। এডেনোভাইরাসের যে দুটি ধরনের টিকা মানুষের হাতে আছে, তাও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয় না। অর্থাৎ, এর নাগাল সাধারণ মানুষের কাছে নেই।
করোনাভাইরাসের একটি টিকার দেখা হয়তো মানুষ পাবে— এমনটাই আশা। কিন্তু শুধু একে কেন্দ্র করেই সব পরিকর।পনা সাজালে চলবে না। হ্যাঁ, অনেকগুলো জায়গায় হিউম্যান ট্রায়াল চলছে। এই সবই আশার খবর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণ না হলে কিন্তু ওই টিকা প্রয়োগ করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে উপায় কী হবে, তার পরিকল্পনাটা আগে থেকে করাই ভালো। এ ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি আমাদের পথ দেখাতে পারে। মানুষ কিন্তু এ দুই ভাইরাসকেও ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু এ দুটিকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার কৌশল ঠিকই বের করেছে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো নির্ধারণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কৌশল, কাঠামোগত পরিবর্তন ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে।