চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্বের নেপথ্যে কী?

ভাইরাসের উৎস নিয়ে চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্ব। ছবি: রয়টার্স
ভাইরাসের উৎস নিয়ে চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্ব। ছবি: রয়টার্স

করোনাকালেও থেমে নেই অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি। বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাউন্সিল থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে দেশ, তারপর বিশ্ব। সব রাজনীতিই চলছে অস্ট্রেলিয়ায়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই দিনে কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও অস্ট্রেলিয়ায় রাজনীতির পাঠ বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। মহামারির কারণে ধরন একটু ভিন্ন হলেও রাজনীতির আদর্শলিপি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত চর্চিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সব মঞ্চেই। চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্বের নেপথ্যে কি নেহাত এ রাজনীতি, নাকি অন‌্য কিছু?

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রথম থেকেই বৈশ্বিক রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি চর্চা করতে দেখা যায় দেশটিকে। অবশ্য এ নতুন নয়, বরাবরই সময়-সুযোগ পেলে এটিই করে থাকে অস্ট্রেলিয়া। বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজেদের নীতি-নৈতিকতা বাদ দিয়ে ঘুরপাক খায় শুধু ক্যানবেরা-ওয়াশিংটন-লন্ডন ধরে। নিজ দলের মধ্যেও প্রতিনিয়ত জ্যেষ্ঠ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য কলকাঠি চালতে ব্যস্ত থাকেন দেশটির রাজনীতিবিদেরা। ফলে দীর্ঘ সময় নিয়ে রাজনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগ দিতে পারেন না অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরাও সমসাময়িক রাজনৈতিক ধাক্কাধাক্কি সামলাতে সামলাতে পার করে ফেলেন দেশের আরও বেশি উন্নয়নের সময়টুকু।

এবার চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার যে দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছে, সেটার ভূমিকাতেই চলে আসে দেশটির বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটনের কথা। তিনি কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ। দীর্ঘদিন শুধু রাজনীতি করছেন, এমন নয়। ২০০১ সাল থেকে কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের ডিক্সন থেকে নিয়মিত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ক্ষমতায়ও আছেন অনেক দিন ধরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদটা কবজা করতে পারছেন না অনেক চেষ্টা করেও। তাই বছরের পর বছর এটা নিয়ে টানাটানি করছেন ডাটন।

২০১৭ সালের শেষ দিক। দেশটিতে ম্যালকম টার্নবুল প্রধানমন্ত্রী। তখন বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে শুরু হয়ে যায় টানাপোড়েন। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন তখন ছিলেন অর্থের দায়িত্বে, পিটার ডাটন স্বরাষ্ট্র ও জুলি বিশপ ছিলেন পররাষ্ট্রের এবং একই দলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট ক্ষমতার কোনো পদে না থাকলেও টার্নবুলের বিরোধিতা করেন রাতদিন। এই চতুর্ভুজ বলয়ের চাপে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের একদিন নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জে পড়েন টার্নবুল।

প্রথম দফায় বেঁচে গেলেও শেষবারে বিরক্ত হয়ে অবসরে চলে যান তিনি। তখন প্রধানমন্ত্রীর ওই পদের যোগ্যতা নিয়ে টার্নবুলের দিকে মূল অগ্নিপরীক্ষাটা ছুড়ে মেরেছিলেন পিটার ডাটন। কিন্তু টার্নবুল যেভাবেই চলে যাক, সরাসরি কারও প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই অস্ট্রেলিয়ায়। নেতৃত্বের পরীক্ষায় বসতেই হয় ডাটনসহ অন্যদের। দলের ভেতর নেতৃত্বের ওই নির্বাচনে ডাটনের সঙ্গে লড়েন ওই চতুর্ভুজ নেতৃত্বের আরও দুজন। পিটার ডাটন মোটামুটি আটঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন। কিন্তু কী কারণে যেন গণেশ যায় উল্টে। এতে দলের নির্বাচকেরা তখন বেছে নেন অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও ভদ্রগোছের স্কট মরিসনকে। ৪৫-৪০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান পিটার ডাটন। ফলে ২৪ আগস্ট ২০১৮ সালের হিম হিম শীতের সন্ধ্যায় দেশটির ৩০তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন স্কট মরিসন।

ক্ষমতায় মরিসন আসার পর থেকে বাকিদের অবস্থা শোচনীয়। বিশপ পদ-পদবি হারিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায়। অ্যাবোটের অবস্থা তথৈবচ, আর এগোতে পারেননি। দেশটির পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে নিজের ওয়ারিঙ্গা সংসদীয় এলাকায় গো–হারা হারেন স্বতন্ত্র এক প্রার্থীর কাছে। ফলে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া তো দূরের কথা, রাজনীতির ভবিষ্যৎই অন্ধকার হয়ে যায় তাঁর। আর অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ায় ম্যালকম টার্নবুল সংসদ সদস্য পদ থেকে তাৎক্ষণিক পদত্যাগ করেন। তারপর সব ছেড়েছুড়ে দেশান্তরি হয়ে যান রাগে-অভিমানে। কিন্তু পর্দার অন্তরাল থেকে কলকাঠি নাড়া বন্ধ রাখেননি তিনি।

কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সংসদীয় এলাকা ওয়েন্টওর্থের উপনির্বাচনে নিজ দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে গুটি চালতে থাকেন। অভিযোগ ওঠে, তখন তাঁর ধনাঢ্য ছেলে অ্যালেক্স টার্নবুল সিঙ্গাপুর থেকে এসে নিজ দলের প্রার্থীকে বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী কেরিন ফেল্পসের পক্ষে কাজ করেন। ফলে দেবানন্দ নুয়েল শর্মা যিনি ডেভ শর্মা হিসেবে পরিচিত। যিনি ভারতীয় পিতা এবং ইহুদি মায়ের সন্তান, দীর্ঘদিন ইসরায়েলে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত, মেধাবী ও চৌকস কূটনীতিবিদ হিসেবে প্রশংসিত, ক্ষমতাসীন দলের ঘাঁটি এবং ইহুদি–অধ্যুষিত এলাকার প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনে হেরে যান। এতে দলের ওপর কিছুটা প্রতিশোধ নেওয়া হলেও টার্নবুল কোণঠাসা হয়ে পড়েন পুরো রাজনীতিতে। বলা হয়, তখন থেকেই তিনি অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েন। শুধু টিকে থাকেন হারাধনের এক, পিটার ডাটন।

দলের একটা বিরাট অংশের সমর্থন থাকায় ডাটনকে আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন মন্ত্রিসভায়। কিন্তু দল ও দলের বাইরে তিনি আগের থেকে আরও বেশি কট্টরপন্থী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রায়ই আলোচনার পাদপ্রদীপে চলে আসেন ঠিকই, কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন কট্টর মন্তব্যের জন্য। তো, সেই পিটার ডাটন আবার আলোচিত হয়ে ওঠেন করোনাভাইরাসের এই সময়ে। অস্ট্রেলিয়ার উচ্চপদস্থ মানুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হন। আক্রান্তের চেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন চীনকে করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করায়।

করোনাভাইরাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন মন্তব্য, পরামর্শ, দোষাদোষী নিয়ে এবার প্রথম দিকে বেশি আগ্রহ দেখায়নি অস্ট্রেলিয়া। নিজেদের রক্ষা করতেই ব্যস্ত ছিল বেশি। কিন্তু পিটার ডাটন ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইস্যু করে তোলেন অস্ট্রেলিয়াকে। অস্ট্রেলিয়া আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা দেশ এমনটি বেশির ভাগ মানুষের ধারণা। তার ওপর বর্তমান লিবারেল পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা একটু বেশিই। কিন্তু যেহেতু পিটার ডাটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথার সঙ্গে মিলে রেখে চীনকে করোনাভাইরাসটির মূল উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছ উত্তর দেওয়ার আহ্বান জানান। প্রথমে সরকারের নীরবতা দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পিটার ডাটনের দেওয়া বক্তব্য সরকারের মুখপাত্র হিসেবে নাকি একক সিদ্ধান্তে দেওয়া জানতে চেষ্টা করে সচেতন মহল। কারণ, পিটার ডাটনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে দেশটির সরকার ও দলের ধারণা রয়েছে স্পষ্ট।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে যায় এমন একটি স্পর্শকাতর বক্তব্য যা থেকে সরকার বেশি দূরে যেতেও পারে না। কারণ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সেখানেই অস্ট্রেলিয়া—এটা বিশ্ব রাজনীতিতে অনেকটা স্পষ্ট। এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক কতটুকু বন্ধুত্বের, পূর্ব তিমুর দেশটির স্বাধীনতা ইস্যু থেকেই আঁচ করা আছে। পূর্ব তিমুর ইস্যুকে প্রথমে ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে ঘোষণা দেয় অস্ট্রেলিয়া। পরবর্তীকালে পূর্ব তিমুর অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিরোধী শিবিরে যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়া।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া এশিয়ার সঙ্গে তার ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় নেয় না। বিভিন্ন ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া অনেকবার প্রমাণ দিয়েছে, এশিয়ার দেশগুলো তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেক দূরের যুক্তরাষ্ট্রই অস্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু চীনের এবারের আচরণ অস্ট্রেলিয়ার সার্বভৌমত্বে আঘাতের সমতুল্য। তারপরও অস্ট্রেলিয়া খুব উগ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। অনেকেই মনে করেন, চীনের বিরুদ্ধে পিটার ডাটনের উঠে আসা প্রশ্ন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষিত। তাই এ নিয়ে চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার অনেক কিছু হলেও সরকার জল বেশি ঘোলা করেনি এখনো। যা করছে ধীরগতিতে।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে। কিন্তু এই ভাইরাসের উৎস নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও দ্বিমত দেখা দেয়। চীন যদিও আগেই বলেছে, বন্য প্রাণীর বাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। তবু কয়েকজন বিজ্ঞানী দাবি করেন, ‘দুর্ঘটনার’ ফলে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে চীনের গবেষণাগার থেকে। এই পরিস্থিতিতে মূল উৎসের স্বচ্ছ উত্তর দেওয়ার দাবি করেন অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন। আর তাতেই চটে যায় চীন। হুমকি দেয় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার। শুরু হয় দুই দেশের বাগ্‌যুদ্ধ।