এ সময়ের বীরদের করতালি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
অলংকরণ : আরাফাত
অলংকরণ : আরাফাত

শীতের এ দেশে সারা বছর এপ্রিলের এ সময়টার জন্য মুখিয়ে থাকি। শীতের গুমোট আবছায়া ভাবটা কেটে গেছে। স্যাঁতসেঁতে ভিজে রাস্তা কী ঝকঝকে! কিন্তু আফসোস। সব লকডাউনে রুদ্ধ। তবে কাজ থেমে নেই। ছাত্রদের সঙ্গে প্রকল্প নিয়ে সভা, পিএইচডি গবেষণা তদারকি, প্রশাসনিক সভা—অনলাইনে পুরোদম চলছে। লকডাউনের কবলে পড়ে অনলাইন শিক্ষকতা আর সভাও আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। ছাত্রদের বোঝানোর জন্য আঁকাআঁকি, প্রশ্ন করার জন্য হাত তোলা, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, অডিওর সঙ্গে ভিডিও আর চ্যাটের—সবকিছুর উপায় আছে অনলাইন টিচিং ব্যবস্থায়। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর আমেজ কি আর তাতে আসে?

লকডাউনের আগে বাজার করার অভিজ্ঞতা এখনো স্মৃতিতে জেগে আছে। ছোট ভাইয়ের পরামর্শে গেলাম লিডলে। সকাল সাতটা থেকে সবার জন্য খোলা। আমি সাতটার একটু পর গিয়ে দেখি, গেট থেকে বেরিয়ে মূল সড়ক অব্দি দূরত্ব মেনে হালকা-পাতলা একটা লাইন। হাঁটছি তো হাঁটছি। লাইন আর শেষ হয় না। মূল সড়কের লাইন বাঁক নিয়েছে পাশের রাস্তায় গাছগাছালির নিচে। লোকজন হাতে মুঠোফোন আর বই নিয়ে ভালোই উপভোগ করছে ভোরের হালকা শীতের আমেজ। ঘণ্টাখানেক পর ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলাম। তালিকার বেশির ভাগে জিনিসই পেলাম। তবে বাকি জিনিসের জন্য আবার লাইন ধরতে হলো আসদায়। সব কিনে বাড়ি ফিরলাম বেলা একটার দিকে।

কেনা জিনিসপত্রে চোখ বুলিয়ে নিতু বলল, ‘সবই ঠিক আছে, তবে বাচ্চাদের বিস্কুট যথেষ্ট পরিমাণে আনা হয়নি।’ আমি নিশ্চুপ। আবার যে বাজারে যাওয়া সম্ভব নয়, সে–ও জানে। শেষ বিকেলে কম্পিউটারে অফিসের কাজ করছি, থেকে থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ এসে মনটা উতলা করে দিল। একটু পরে প্লেটে দুই ধরনের বিস্কুট নিয়ে নিতু এসে বলল, ‘ওভেনে এগুলো বানালাম। একটা ময়দার আর একটা আটার।’ আমি অবাক। বিশেষজ্ঞরা লকডাউন শেষে জীবনজগতে নানা পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। মনে হলো তারই একটা ছোট ইঙ্গিত। শুধু ঘরে খাবার তৈরি করাই নয়, সময়টা মিতব্যয়ী হওয়া আর অপচয় রোধের কলাকৌশল শেখার জন্যও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ঘন ঘন মৃত্যুর খবরে কাছের মানুষ আর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উত্কণ্ঠায় দিন কাটে। উদ্বেগটা ডাক্তার আর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএসে যে বন্ধুরা কাজ করে তাদের নিয়ে একটু বেশি। কুশল জানতে টেক্সট করেছিলাম বন্ধু ও সহ-গবেষক ডাক্তার আদনানকে। ওর উত্তর একেবারে আপ্লুত করে দিল, ‘ভাইরাসের নিয়ে আসা অনিশ্চয়তা, ভয় ও উদ্বেগের মুহূর্তে গোটা বিশ্বের আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় আমি কৃতজ্ঞ। সবাই একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। মানুষকে সেবার এত বড় একটা সুযোগ যে পেয়েছি, এ তো বিরাট একটা আশীর্বাদ। বাচ্চারা আমাকে নিয়ে গর্ব করে। আমি নিশ্চিত, সব এনএইচএস পরিবারের অনুভূতি একই রকম।’ আদনানের বাচ্চা দুটো আমার খুব কাছের।

ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে এখানকার লোকজন দারুণ কৃতজ্ঞ। তাঁদের নিয়ে একটা আয়োজনের কথা বলি। গত ২৬ মার্চ রাত আটটায় বাইরে করতালির শব্দ শুনে সবাই দৌড়ে গেলাম জানালার দিকে। দেখি, লোকজন দরজায় দাঁড়িয়ে, জানালা থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে করতালি দিচ্ছে। শিশুরা পেটাচ্ছে হাঁড়ি-পাতিল আর থালা-বাসন। অনেকে শব্দ তুলেছে বাশিতে ফুঁ দিয়ে। আমরাও শুরু করলাম করতালি। স্বাস্থ্য, ডাকসেবা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ডেলিভারি ড্রাইভারসহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনের সারিতে থেকে এ দুঃসময়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাতে এ আয়োজন। পুরো জাতি শামিল এ আয়োজনে। সেই থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার, ঠিক আটটায় এ আয়োজন চলছে। বাচ্চাদের নিয়ে এই সময়টার অপেক্ষায় থাকি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এত চমৎকার আয়োজনে শামিল না হয়ে কি পারা যায়?

হাসান শহীদরিডাররোবটিকস ও রিনিউয়েবল এনার্জি, কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, যুক্তরাজ্য