করোনার পর কী হবে জাপানে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রমোদতরি ডায়মন্ড প্রিন্সেস জাপানের উপকূলের কাছে এসে পৌঁছার পর থেকে করোনার সংক্রমণ নিয়ে জাপানে হইচই শুরু হয়। জাপানে এ ভাইরাসের সংক্রমণের আড়াই মাস চলছে। এ ভাইরাসের মোকাবিলায় লকডাউনে যায়নি জাপান। জরুরি অবস্থা জারি করে নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে আসছে জাপান। তাদের মূল ভাবনা এখন করোনা–পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে।

জাপানে এখন করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সীমিত। সমালোচকেরা এর আগে করোনা মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় সেই ঝড় থেমেছে। এখন তাঁরা বলছেন, জাপানের এই সাফল্য ঘটনাক্রমিক। করোনার আরেক দফা ঢেউ এলে জাপানের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয় তরঙ্গের আগমনের আশঙ্কা জাপান একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না। তবে এ নিয়ে জাপান খুব বেশি ভাবছে না। করোনা নিয়ে গবেষণা যে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, এতে খুব শিগগির এর ওষুধ চলে আসবে বলে মনে করছেন জাপানের বিশেষজ্ঞরা। ফলে তাঁদের দৃষ্টি এখন ভাইরাস সমস্যার অন্য দিকগুলোতে ক্রমশ সরে যাচ্ছে। জাপানের নীতিনির্ধারকেরা এখন করোনার দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ নিয়ে যতটা না উদ্বিগ্ন, এর চেয়ে বেশি ভাবছেন করোনা–পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবিলা নিয়ে।

সংখ্যা ধরে ক্রমাগত সাফল্য এলেও সাবধানতার পথ থেকে জাপান সরকার এখনো সরে আসেনি। জরুরি অবস্থার মেয়াদ চলতি মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সরকার বলছে, পরিস্থিতির অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে ৪৭টি জেলার মধ্যে ৩৪টিতে জরুরি অবস্থা কিছুদিনের মধ্যে তুলে নেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে যে ১৩টি জেলায় প্রতিদিনের সংক্রমণ এখনো দুই অঙ্কের বেশি, সেগুলোর বেলায় জরুরি অবস্থা বহাল থাকতে পারে। এই ১৩টি জেলায় দিন দিন করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। এ তালিকায় অবশ্য শীর্ষে রয়েছে রাজধানী টোকিও।

সোমবার টোকিওতে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১৫টি। এটি ৩০ মার্চের পর থেকে সর্বনিম্ন এবং টানা ছয় দিন ধরে অঙ্কটা পঞ্চাশের নিচে। এর আগে ১৭ এপ্রিল সংক্রমণ ২০১ জনে পৌঁছালে এ নিয়ে টোকিওতে আতঙ্ক ছড়ায়। তবে তা এখন অনেকটাই দূর হয়েছে। আড়াই মাসে, ১১ মে পর্যন্ত জাপানে করোনায় মারা গেছেন ৬২১ জন। পশ্চিমা দেশগুলোর করোনা পরিস্থিতির তুলনায় এ ক্ষতি সামান্যই।

দেশের নেতাদের পাশাপাশি নাগরিক মনকে এখন প্রশ্নটি নাড়া দিচ্ছে, তা হলো করোনা–পরবর্তী সময়ে দেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে?

কারণ, করোনার বিস্তার রোধে জারি করা জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় এর মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে বিভিন্ন খাতকে। বড় আকারের কোম্পানি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আরও কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। অন্য যারা এখনো টিকে আছে, সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন তাদের জানাতে হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে মানব কর্মকাণ্ড আচমকা থমকে দাঁড়ানোয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি শুরুতেই হয়েছে পর্যটন ও পরিবহন খাতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাজার হাজার কর্মী হঠাৎ শুরু হওয়া সেই মন্দায় চাকরি হারিয়েছেন। জাপানে বেড়ে চলেছে বেকার জনসংখ্যার হার। জাপানের অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান তেইকোকু ডেটা ব্যাংক এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে একটি গবেষণা ও বিশ্লেষণ চালিয়ে দেখিয়েছে যে সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন না পেলে কোম্পানির বিক্রয় অব্যাহতভাবে হ্রাস পেতে থাকবে।

১১ মাস সময়ে ৬ লাখের বেশি কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়ার মতো বিপদে পড়বে। চাকরির বাজারে এর ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। অতিরিক্ত আরও ২০ লাখের বেশি মানুষ চাকরি হারাবে এবং দেশের বেকার জনসংখ্যার হার মার্চের ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী পথে এগিয়ে গিয়ে বছর শেষ হওয়ার আগে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে।

এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৩০ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, জাপানের জন্য যা হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির সবচেয়ে খারাপ ফল। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রাণহানির সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হলেও অর্থনৈতিক কারণে জীবননাশের হুমকি এখন অনেক বেশি গভীর হয়ে দেখা দিচ্ছে।

সংকটের এই গভীরতা সম্পর্কে সরকারের পাশাপাশি সার্বিকভাবে জাপানের সমাজ এখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রশাসন পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্বিতীয় একটি সম্পূরক বাজেট প্রণয়নের চিন্তাভাবনা করছে। সংকটকবলিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধারে জোগান দেওয়া অর্থের বরাদ্দ বাজেট বিলে রাখা হবে। তবে সরকারের তহবিলও তো অফুরান ভান্ডার নয়। জাপান ঋণজর্জরিত একটি দেশ। করোনা–পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও বেশি ঋণ সরকারকে অবশ্যই করতে হবে। ফলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে এর পরিণতি, তা মনে হয় কারোরই জানা নেই। তাই বিভিন্ন দিক থেকে নানা রকম সুপারিশ জাপানের উদ্দেশে করা হচ্ছে।