চীন-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক: বন্ধুত্ব থেকে মাথায় মাথায় ঢুস

চীন ও অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসছে। প্রতীকী ছবি
চীন ও অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসছে। প্রতীকী ছবি

অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাস নির্মূল হয়নি পুরোপুরি, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ কারণে এ ভাইরাস নিয়ে বিধিনিষেধ পর্যায়ক্রমে উঠতে শুরু করেছে দেশটিতে। করোনাযুদ্ধে এ পর্যন্ত সফল কয়েকটি দেশের একটি অস্ট্রেলিয়া। জুলাই নাগাদ পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এমন আভাস দিয়েছে সরকার। এই সফলতার পরও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ নেই অস্ট্রেলিয়ার। করোনার উৎপত্তিস্থল নিয়ে তদন্তের কথা বলে চীনের সঙ্গে বিরোধ জড়িয়ে পড়েছে তারা। শুরু হয়েছে  বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব।

গত মাসের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া যখন চীনকে বিশ্ব মহামারি করোনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্তের প্রস্তাব দেয়, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তখন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বর্জন করার প্রকাশ্য হুমকি দেয়। এতে করোনাকালের এই বৈশ্বিক রাজনীতির সময়ে চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বরাবর উচ্চারিত আপ্ত বাক্য ‘ভালো ও খারাপ উভয় সময়ে আমরা একত্রে থাকব’ এর একটা কঠিন পরীক্ষা হয়ে যায়। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এ কথা বলেন। এর পর থেকে দ্বিপক্ষীয় যেকোনো ইস্যুতে এ প্রসঙ্গ তোলা হতো।

অস্ট্রেলিয়ার একটি অংশ মনে করে,  চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বছরের পর বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করতে পদ্ধতিগতভাবে কাজ করে চলেছে। তবে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ থাকলেও সরাসরি এমন দ্বন্দ্ব কখনো দেখা যায়নি। সরকার এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে, তা জানা কঠিন। কারণ, দ্বন্দ্বটা প্রথমে গণমাধ্যমবান্ধব হলেও পরে গোপন কূটনৈতিক পর্যায়ে চলে গেছে। বাইরের দৌড়ঝাঁপ দেখে সে খবরের প্রকৃত গতিবিধি এখনই হয়তো জানা যাবে না। তবে একঝলক যা দেখা গেছে, তা থেকে দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সচেতন নাগরিকেরা মহামারির এই দুর্যোগের সময় ঠিকই দেখে নিয়েছেন কথিত বন্ধু চীনের ওপিঠে থাকা বন্ধুত্বের আসল রূপ। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে, দেশটির অর্থ আগে, না সার্বভৌমত্ব আগে? কোথাও কোথাও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবার পরামর্শও দিয়েছেন দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ১৮৭টি দেশের অর্থনীতি করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে প্রায় ভেঙে পড়েছে। এই মহামারিতে এ পর্যন্ত শুধু ৪২ লাখ মানুষই আক্রান্ত হয়েছে, তা নয়। মৃত্যুবরণও করেছে ২ লাখ ৯১ হাজারের বেশি মানুষ। কোনো দেশভিত্তিক নয়, বিশ্ব অর্থনীতির চাকা ভেঙে পড়েছে ভয়ংকরভাবে।

অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলছে, প্রতি সপ্তাহে ৪০০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার খরচ হচ্ছে এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পেছনে। এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের মূল উৎসের স্বচ্ছতা দাবি করেন অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন। তিনি অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী। ভেতরে যা-ই থাকুক, তাঁর উত্থাপিত দাবি সরকারের, একটি দেশের। তাঁর দাবির সমর্থনে দেশটির প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই একমত।

বলা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রিসভার জাতীয় সুরক্ষা কমিটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মরিসন নিজেই এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। এরপর মার্কিন দপ্তর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ সমর্থন করেছিল অস্ট্রেলিয়ার ওই দাবিকে। যদিও ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চীনের সম্পর্কে এক মন্তব্য করে বিরোধী দল লেবার পার্টির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবুও এবার চীনের সঙ্গে  উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে লেবার পার্টির পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র এবং সিনেটে বিরোধীদলীয় নেতা পেনি ওয়াং সরকারের এই তদন্তের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশের মতো চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবশ্যই স্বীকৃত ও সার্বভৌম। আমাদের মূল্যবোধ ও স্বার্থ দ্বারাই আমরা পরিচালিত হবে। সম্পর্কের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা দরকার, তবে সিদ্ধান্তহীনতা কোনো বিকল্প নয়।’ কিন্তু তদন্তের এই প্রস্তাবের বিপরীতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রথমে অস্ট্রেলিয়াকে বাণিজ্য বর্জন করার প্রকাশ্যে হুমকি দিল দেরি না করেই।

চীন যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে, তা সরাসরি সার্বভৌমত্বে আঘাত না হলেও আঘাতের থেকে খুব বেশি দূরেও নয়, এমনটাই বলছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এর রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক পিটার হার্টচার। তিনি এক দীর্ঘ নিবন্ধের শিরোনামই করেছেন ‘অর্থ বা আমাদের সার্বভৌমত্ব: চীন আমাদের কোনো বিকল্প দেয়নি’। তিনি লেখেন, অস্ট্রেলিয়া এখন সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এটি এখন সার্বভৌমত্ব এবং অর্থের মধ্যে সুস্পষ্ট পছন্দসহ উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি সরাসরি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘সার্বভৌমত্ব বা অর্থ। অস্ট্রেলিয়ার পছন্দ কোনটি?’

অন্যদিকে, চীনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফেন ফিজজেরাল্ড এক কলামে লেখেন,  অস্ট্রেলিয়া যেন কোভিড-১৯-এর এই ‘ব্লেম গেমে’ না জড়ায়। তিনি অনেকটা আক্ষেপ করে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে প্রশ্ন করেন, ক্যানবেরার সরকারে এমন কেউ কি আছেন যিনি বেইজিংয়ের সিনিয়র স্তরের কাউকে ফোন করে কথা বলতে পারেন?

এর মানে দাঁড়ায়, যদি কেউ না থাকে, তাহলে এই বিবাদে না জড়ানো ভালো। সঙ্গে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের দীর্ঘকালীন প্রিমিয়ার এবং অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বব কার ‘আমরা আবার চীনের সঙ্গে অপেশাদার কূটনৈতিকতা দেখালাম’ শিরোনামে এক মতামত নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় একটি সম্পর্ক রয়েছে চীনের সঙ্গে। আমরা বলছি না ইস্যুটি বাদ দেওয়া হোক। তবে একটু সময় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে সংবাদমাধ্যমের বাইরে।’ এ তো গেল অস্ট্রেলিয়া পক্ষের  বিভিন্ন স্তরের কথা।

চীনা কর্তৃপক্ষ প্রথমে শুরু করল ক্যানবেরা থেকে। তাদের দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বললেন, ‘কিছু অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিবিদ আছেন, তাঁরা আমেরিকার তোতা পাখি।’ তারপর ডাটনকে সরাসরি আখ্যা দেওয়া হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাউথপিস’ বলে। তারপর আরও একধাপ, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার প্রকাশ্য হুমকি। অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চেং জিংয়ে বলেন, ‘কথা বেশি গড়ালে শিক্ষা, পর্যটন, কৃষিক্ষেত্রের লেনাদেনা চীনা মানুষ হয়তো বর্জন করা শুরু করবে। যে দেশ চীনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, সে দেশের মদ-মাংস খেতে চীনারা হয়তো দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে।’

চীন সরকারের চালিত সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর সম্পাদক হু জিজিন অস্ট্রেলিয়াকে বর্ণনা করেন ‘চীনের জুতায় লেগে থাকা চুইংগাম’ হিসেবে। কিন্তু কেন এতটা চটে গেল চীন, এসব নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ হচ্ছে। চীনের এত শক্ত ও উগ্র প্রক্রিয়ার বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রশ্ন তুলছেন, আসলে অস্ট্রেলিয়ার অপরাধটা কী? এই তো, বিশ্বব্যাপী মহামারি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি। আর কী? যুক্তরাষ্ট্রের পরপর অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সুরে সুরে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের তালে তালে নাচে অস্ট্রেলিয়া।      

অস্ট্রেলিয়া ও চীনের মধ্যকার সামাজিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুমাত্রিক। অস্ট্রেলিয়ার আড়াই কোটি মানুষের দেশে ১২ লাখ চীনা বংশোদ্ভূত মানুষের বসবাস, যাঁদের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী। চীন অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর রপ্তানি বাজার। আবার অস্ট্রেলিয়ার ৯০ শতাংশ আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য আসে চীন থেকে। ২০১৮ সালে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের। ২০১৮-১৯ সালে ১৪ লাখ চীনা পর্যটক অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে আসেন। আর এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অস্ট্রেলিয়া ও চীনের অনেক বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী, যাঁরা অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য থেকে শুরু করে রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেন প্রায়ই। রাজনীতিতে তাঁদের দাপট অনেকবার দেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকেরা।

২০১৮ সালের আগস্টে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল যখন ক্ষমতা হারান, তখন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মার্ডক ও কেরি স্টোকসের নাম চলে আসে এর পেছনে কলকাঠি নাড়ার অভিযোগে। এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে আবার স্কট মরিসনের ক্ষমতায় আসার পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যদের সঙ্গে নাম আসে অস্ট্রেলিয়ার আরেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আন্ড্রু ফরেস্টের, যিনি টুইগি ফরেস্ট নামে সমধিক পরিচিত। আবার এবারও চীন-অস্ট্রেলিয়া দ্বন্দ্বে যে কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে টুইগি ফরেস্ট অন্যতম। তিনি অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমের রাজ্য ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের মালিক।  চীনের সঙ্গে বড় ব্যবসা। তাঁর ফোর্টসকি মেটাল গ্রুপের লোহার সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন। তার ওপর এবার যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু হলো তখন স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা পোশাক ও ভাইরাস শনাক্তকরণ কিটের অভাবে অন্ধকার দেখছিল অস্ট্রেলিয়া। সরকার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কোনোভাবেই এই অতিপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারছিল না কোথাও থেকে। তখন এই এক টুইগি ফরেস্ট তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগে ৩২ কোটি ডলারের স্বাস্থ্য সুরক্ষার পোশাকসহ ১ কোটি টেস্ট কিট এনে দিয়েছিলেন চীন থেকে।

স্বভাবত চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া লেগে যাওয়ায় চটে যান টুইগি ফরেস্ট। তৎক্ষণাৎ কয়েক হাত দেখেও নেন অস্ট্রেলিয়া সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধার করে। উড়ে যান মেলবোর্নে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী গ্রেগ হান্টের প্রেস বিফিংয়ে। হাজির হন সদ্য  অস্ট্রেলিয়াকে কটাক্ষ করা দেশ চীনের ভিক্টোরিয়ার কনসাল জেনারেল লং জাওকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে আবার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগও করে দেন তাঁকে। লং জাও-ও কম যান না, স্মরণ করিয়ে দেন চীনের স্বাস্থ্য সামগ্রী দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সহযোগিতার কথা। এ সময় গ্রেগ হান্ট অনেকটা মুখ গোমড়া করেই দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশে আর টুইগি ছিলেন পাহারাদার ভঙ্গিতে। এ নিয়েও পানি অনেক ঘোলা হয়েছে। কীভাবে ওই কনসাল জেনারেল একটা স্পর্শকাতর সময়ে ওখানে শুধু উপস্থিত নয়, বক্তব্যও দিলেন। জাওয়ের  উপস্থিতিসংক্রান্ত স্পষ্ট বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। তবে জানা গেছে, ওই স্বাস্থ্য সামগ্রী বিনা মূল্যে পাওয়া নয়, অস্ট্রেলিয়া সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে এর যাবতীয় মূল্য।

আবার অন্যদিক বিবেচনা করে অনেকে অস্ট্রেলিয়ার দিকেই অঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন। তাঁদের কথা, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিয়মিত হুমকি-ধমকি সহ্য করে এই কাজের বিশেষ পেশাদার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু বারবার করোনাভাইরাস মনুষ্যসৃষ্ট নয় বলে ঘোষণা দিচ্ছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়া কেন আগ বাড়িয়ে বেড়ার আগুন চালে লাগিয়েছে, সে প্রশ্নও ঘুরছে দেশজুড়ে। যে আগুনের কিঞ্চিৎ স্ফুলিঙ্গ সবে দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা অবস্থাদৃষ্টে মনে করেন, অস্ট্রেলিয়াকে বাগে পেয়েছে চীন। ঝিয়ের অপরাধ  যত কমই হোক এবার বউকে শিক্ষা দিতে ঝিয়ের ওপর বেশিই যাবে মার। এক অস্ট্রেলিয়াকে দেখে যেন সব দেশের শিক্ষা হয়ে যায়, সেই ব্যবস্থাই করছে চীন। ফলে, চীন এবার অস্ট্রেলিয়ার ওপর ছক্কা বেশিই হাঁকাবে।

আমেরিকার সঙ্গে নাচলে এর মাশুলটা কেমন দিতে হয়, সেটা চীন বাস্তবে অস্ট্রেলিয়াকে কেমন দেখায় সময়ই বলে দেবে। টুইগি ফরেস্টদের লোহা বা  আকরিকের ওপর এখনো আঁচড় পড়েনি, তবে সোমবার অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত বার্লি বা যবের ওপর ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কর বসানোর কথা জানিয়েছে চীন। আবার গত মঙ্গলবার স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাংস আমদানি। এর ফলে শুধু সরকার নয়, পুরো অস্ট্রেলিয়ার কপালেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে একটা। কারণ অস্ট্রেলিয়ার ৮৮ শতাংশ বার্লি রপ্তানি হয় চীনে এবং অস্ট্রেলিয়ার যে প্রধান ৪টি মাংস ব্যবসার আমদানি স্থগিতাদেশপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের ৩৫ শতাংশ মাংস রপ্তানি হতো চীনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রকম একটা দেশের সঙ্গে কথা বলার আগে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। আবেগে হয়তোবা কিছু একটা বলে দেওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের ওপর অস্ট্রেলিয়ার যে ব্যবসায়িক-অর্থনৈতিক নির্ভরতা, তা থেকে বের হতে হলে কমপক্ষে ২৫ বছরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেখানে সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা কিছু বলে দেওয়া বোকামির সমতুল্য। অস্ট্রেলিয়া অভিবাসী দেশ। ফলে অস্ট্রেলিয়ানদের মাঝে জাতীয়তাবাদ চেতনা কিছুটা কম। সরকারও অনেকটা দায়িত্বশীল চাকরিজীবীর মতো। তাই অস্ট্রেলিয়া সরকার চীনের এই তিক্ততাকে নিয়ে কোন পথে হাঁটছে, তা পুরোপুরি বুঝতে সময় নেবে।

তবে এখন চীন ও অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক যে অবনতির দিকে যাচ্ছে, সেটা পরিষ্কার। এর থেকে  উত্তরণে কিছুটা পরামর্শ দিয়েছেন সিডনির ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের আইন অনুষদের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ওয়েইহুয়ান জাও। তিনি চীনা বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে  ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ দূরে রেখে অস্ট্রেলিয়াকে উত্তেজনা হ্রাস করতে এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কারণ অস্ট্রেলিয়ান গ্রাহকের কাছে চীন এখনো অপূরণীয়। অন্যদিকে, চীনের এই শক্ত আচরণ অস্ট্রেলিয়ার জন্য ঘুমজাগানিয়া ধাক্কা বলে বর্ণনা করছেন অনেকে। বাকিটা অস্ট্রেলিয়ার ওপর নির্ভর করবে। তারা কি জেগে উঠবে, নাকি ভাসবে বসন্তের হাওয়ায় আরও কিছুকাল। তবে  পিটার হার্টচার মহামতি লেনিনের কথা টেনে তাঁর নিবন্ধে বলেছেন, ‘পুঁজিপতিরা আমাদের লোহা বিক্রি করবে শিকল বানিয়ে আমাদেরই বাঁধার জন্য।’