জাপানের করোনাহীন সাদো থেকে বলছি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনার ভয়ে যখন পৃথিবীবাসী ভয়ে থরথর করছে, তখন জাপানে নিজের জীবনের জন্য নয়; অন্যের জীবনের জন্য, বাংলাদেশের পরিবার-পরিজন আর দেশের মানুষের জীবনের জন্য ভয়ে তটস্থ। নিজের জীবন নিয়ে নির্ভয় থাকার কারণ, জাপানের যে শহরে আমি থাকি, সেই সাদো দ্বীপে এখনো কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি, কেউ মারা যায়নি, যা এক বিস্ময়কর ঘটনা। ভয়হীন গ্রিন সিটি সাদোকে স্বর্গ স্বর্গ লাগে। 

করোনা থেকে সাদোর এ নিরাপদ থাকার মূল কারণ, দ্বীপটির মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নতা! তা ছাড়া সাদোবাসীর, জাপান সরকারঘোষিত নির্দেশনা, সামাজিক দূরত্ব, মাস্কিং, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার, হোম কোয়ারেন্টিন ও স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলা।

 
প্রায় এক লাখ লোকের বাস এই অপরূপ সাদো দ্বীপে। নিগাতা শহর থেকে ফেরিশিপে আসতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। স্বর্ণখনির জন্য বিখ্যাত এই দ্বীপে একসময় আন্দামান দ্বীপের মতো, পরাজিত রাজা, সামুরাই আর বিপ্লবীদের নির্বাসনের দ্বীপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। করোনা আতঙ্ক শুরুর পর থেকে, বাইরে থেকে সাদোতে কেউ এলে; নিজ জীবন ও অন্যের জীবনের সুরক্ষার জন্য বিনা প্রশ্নে, নিজ দায়িত্বে যথাযথ ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকে। ফলে পুরো দ্বীপশহরটা নিরাপদ ও করোনামুক্ত। 


সাদো ও জাপানের করোনার বিস্তার নিয়ে আমার ভয় ও আগ্রহ না থাকলেও, বাংলাদেশ নিয়ে আতঙ্কের সীমা নেই। ঘণ্টায় ঘণ্টায় অনলাইন সংবাদপত্রে, ফেসবুকে খবর নিই। মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধিতে বুকের পিলে কেঁপে ওঠে। স্কাইপে ও মেসেঞ্জারে বন্ধুদের সঙ্গে বারবার কথা বলতে বলতে আমি হয়রান, ক্লান্ত। আমার এই অস্থিরতার মূল কারণ বাংলাদেশিরা তুলনামূলকভাবে স্বার্থসচেতন হলেও, স্বাস্থ্যসচেতন নয়, বৈজ্ঞানিক কারণ এবং সুরাহা বুঝতে ও মানতে চায় না, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে! সামাজিক গণমাধ্যমে নানান ধরনের মিথ্যা তথ্য, অব্যবস্থাপনা, গজব ও গুজবের ছড়াছড়ি দেখে হতবাক হই। অনেকে নানান ধরনের কৌতুক-চুটকির ছবি ও ভিডিও এখনো ছড়াচ্ছে! ভাবখানা এমন যেন, সবাইকে করোনায় ধরলেও, নিজে নিরাপদে থাকবে। মোটিভেশনাল ভিডিও ও বাণী তৈরি করে অনেকে নীতি কথা শোনাচ্ছে, যাতে চমক থাকলেও বাস্তবতা নেই।


সাদোসহ জাপানের মফস্বলের অফিসগুলো খোলা। দুই দফা খোলার পর, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সাদোর স্কুলগুলো এখন বন্ধ। করোনার পাশাপাশি এখন গোল্ডেন উইকের বার্ষিক ছুটি চলছে। 


সারা দুনিয়াতে মেগা সিটিগুলোতে লকডাউন হলেও, জাপানের কোনো সিটি এখনো লকডাউন হয়নি। টোকিও, ওসাকাসহ বেশ কয়েকটি জনবহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম হলেও যথারীতি ট্রেন চলছে। ঢিমেতালে স্বাভাবিক জীবন, কাজকর্ম চলছে। সব জাপানি শিক্ষিত ও সচেতন হওয়ার কারণে, স্বাস্থ্যজ্ঞান মেনে চলার কারণে, এখন করোনা কম ছড়াচ্ছে, দিন দিন কমছে। সাদোতে মানুষ মারা না গেলেও, কেউ আক্রান্ত না হলেও, মূল শহর নিগাতাতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৫ জন, আর সুস্থ হয়েছেন ৩২ জন।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনার আতঙ্কের মধেই ১২ এপ্রিল সাদোতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে। সাদো প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে আমি অনেকটা বোকামি মনে করেছিলাম। চরম ভয় বুকে নিয়ে এক প্রার্থীর লাইভ ভিডিওগ্রাফির অ্যাসাইনমেন্ট করেছি। প্রথমদিকে মৃত্যুভয়ে ছিলাম, মাঠে যাওয়ার পর বুঝলাম, জাপানিরা বেশ সতর্ক। পুরোপুরি সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানছে, স্বাস্থ্যবিধি মানছে। আমার ভয় থাকলেও, জাপানি সঙ্গীরা তেমন ভয়ার্ত ছিলেন না। সাদোর চারদিক খোলামেলা, বিশাল পরিবেশ থাকার পরও, আমার মনে বাংলাদেশি ভয় কাজ করে। তাই বাড়ির বাইরে অতি প্রয়োজন ছাড়া যাই না। ঘরে থাকি, কাজ করি, নিয়মিত দেশের খবর রাখি।

জাপানিদের স্বভাব, সমস্যায় পড়লে এরা অন্যকে দোষারোপ করে না, অভাব-অভিযোগ করে না, পরিস্থিতি চারদিক ঘোলাটে করে না। সবাই মিলে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই চেষ্টা করে। যা অনেকটা বাংলাদেশের উল্টো।

লক্ষণীয়, জাপানে সতর্কতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ঘটনা, সুস্থ হওয়ার গল্প। যার উদ্দেশ্য মানুষকে ভয়মুক্ত রাখা, মনোবল বৃদ্ধি করা, মোকাবিলার সাহস দেওয়া। বিখ্যাত কেউ মারা গেলে জনসচেতনতার অংশ হিসেবে টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ ডকুমেন্টারি। করোনার আক্রমণে বিখ্যাত উপস্থাপক ওকায়াকা আর কমেডিয়ান শিমুরা কাইশ্যার মৃত্যুতে সারা জাপান স্তম্ভিত। 

শিক্ষা ও গণতন্ত্র যে কত শক্তিশালী, জাপানিদের না দেখলে বোঝা যায় না। কেউ সরকার ও হাসপাতালের নির্দেশ অমান্য করছে না। কোনো উপসর্গ দেখা দিলে জাপানিরা হাসপাতালে যায়।
জাপান ও বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি, মানুষের আচার ও দুই দেশের সরকারে সহযোগিতার ধরন তুলনা করে বুঝলাম, বাংলাদেশের সরকার ও মানুষকে আরও সজাগ, সচেতন ও সতর্ক হওয়া দরকার। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মাস্কিং, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, হোম কোয়ারেন্টিন ও আক্রান্তদের আইসোলেশনের বিকল্প নেই। 

যাহোক, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, জাপানে ও সাদোতে মানুষকে ঘরে রাখার জন্য, করোনা–সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য, ভারত আর পাকিস্তানের মতো পুলিশকে লাঠিপেটা করতে হয়নি। নাগরিকদের সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গেই, সবাই নিজ দায়িত্বে বিধি মেনেছে। এই সফলতার মূল কারণ জাপানে ও সাদোতে শতভাগ শিক্ষিত, সচেতন ও বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক। ধর্মের নামে, কর্মের নামে, সাহায্যের নামে এখানে কেউ গজবের গুজব ছড়ায়নি, জমায়েত করেনি। ভয় না পেয়ে মানুষ মোকাবিলা করেছে।
লেখক: আলোকচিত্রী ও মাল্টিমিডিয়া ডিজাইনার।