ভারতে করোনা: যুদ্ধজয় বাদ, আপাতত সহাবস্থান

পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষায় আছেন। দিল্লির কাছে নয়ডায়। ছবি: রয়টার্স
পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষায় আছেন। দিল্লির কাছে নয়ডায়। ছবি: রয়টার্স

লকডাউনের ৫৫ দিনের মাথায় ভারতে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী মঙ্গলবার দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১ হাজার ১৩৯। মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ১৬৩। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৭০ জন। ওই সময়ে মারা গেছেন ১৩৪ জন।

সংক্রমিতের সংখ্যা লাখের সীমানা টপকে গেলেও আশার কথা, গত প্রায় দুই মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৪০ হাজার ভারতীয়। আরও একটি তথ্য, প্রতি ১ লাখ জনতা পিছু ভারতে সংক্রমিত হচ্ছেন মাত্র ৭ দশমিক ১ জন। তুলনায় পশ্চিমা দুনিয়ায় সংক্রমণের হার এক লাখে কম করে ৬০ জন। সুস্থ হয়ে ওঠার হারও অন্য দেশের তুলনায় ভারতে বেশি। ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মৃত্যুর হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ যা চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক কম। এই পরিসংখ্যান পেশ করা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো এই কথা বলতে রাজি নয় যে ভারতীয়দের ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বেশি।

ভারতে প্রথম লকডাউন হয় ২৪ মার্চ রাত ১২টা থেকে। ২১ দিনের জন্য। তখন দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬১৮, মারা গিয়েছিলেন মাত্র ১৩ জন। তারপর লকডাউনের মেয়াদ চারবার বাড়ানো হয়েছে। আপাতত দেশ অবরুদ্ধ ৩১ মে পর্যন্ত। লকডাউন করার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, মহাভারতের যুদ্ধ আঠারো দিনে শেষ হয়েছিল, করোনা নামক যুদ্ধ জয় করতে তিন দিন বেশি সময় লাগবে। কিন্তু তা না হওয়ায় এবং আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখের গণ্ডি পেরোনোর এখন সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে, করোনার সঙ্গে সহাবস্থানের অভ্যাস দেশবাসীকে শিখতে হবে।

এই সহাবস্থান ও লড়াই কত দিন পাশাপাশি চলবে, সরকারের তা অজানা। তবে শুরুর দিনগুলোয় যে লড়াই ছিল প্রধানত জীবন রক্ষার, এখন তা জীবিকা রক্ষারও হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের হাতে কাজ দিতে ও রোজগারের ব্যবস্থা করতে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো গোটা দেশেই ধীরে ধীরে শুরু করা হচ্ছে। বিধিনিষেধ মেনে অধিকাংশ দোকান খোলা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, কলকারখানাও। উৎপাদন শিল্পও চালু করা হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্র আগেই উন্মুক্ত। তবে ট্রেন, বিমান ও মেট্রো চলাচল সারা দেশেই বন্ধ। আন্তরাজ্য বাস ও ট্রাক চলাচলও বন্ধ। চলতি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মল, সিনেমা, থিয়েটার, সেলুন, স্পা ও সাধারণের জন্য সব ধরনের ধর্মস্থান। এই সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্য সব ধরনের সমাবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে যান চলাচল শুরু হলেও রাজ্য সরকার যাত্রী বহনের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। সন্ধে সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত সর্বত্রই কারফিউ জারি রয়েছে। ৬৫ বছরের বেশি ও ১০ বছরের কম বয়সীদের অকারণে পথেঘাটে বেরোনোর ওপরেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

ভারতে সবচেয়ে খারাপ হাল মহারাষ্ট্রের। আক্রান্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে মহারাষ্ট্রই শীর্ষে। মোট সংক্রমিত ৩৫ হাজার ৫৮ জন। এই রাজ্য মারা গেছেন ১ হাজার ২৪৯ জন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তামিলনাড়ু। আক্রান্ত ১১ হাজার ৭৬০। তৃতীয় স্থানে গুজরাট ( ১১ হাজার ৭৪৫) ও চতুর্থ স্থানে দিল্লি (১০ হাজার ৫৪)। এর পর একে একে রাজস্থান (৫ হাজার ৫০৭), মধ্য প্রদেশ (৫ হাজার ২৩৬), উত্তর প্রদেশ (৪ হাজার ৬০৫), পশ্চিমবঙ্গ (২ হাজার ৮২৫) ও অন্ধ্র প্রদেশ (২ হাজার ৪৭৪)।

করোনাকে কেন্দ্র করে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের কোন কোন এলাকা বিপজ্জনক, তা কেন দিল্লি থেকে ঠিক করে দেওয়া হবে? রাজ্যের পাওনা টাকা ও করোনা মোকাবিলার সরঞ্জাম সময় মতো না দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে উঠছে। ইদানীং কেন্দ্র-রাজ্য টানাপোড়েন চলছে মৌসুমি শ্রমিকদের ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো রাজ্য ‘শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন’ ঢুকতে দিতে রাজি নয়। এই পরিস্থিতিতে রেল মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানায়, গন্তব্য রাজ্যে পৌঁছাতে গেলে কোনো শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে সেই রাজ্যের অনুমতি নিতে হবে না।

মৌসুমি শ্রমিকদের ফেরানো নিয়ে কেন্দ্র প্রথমে রাজি ছিল না। কিন্তু তাদের দুর্দশা ঘোচানোর তেমন সুপরিকল্পিত চেষ্টাও কেন্দ্রের পক্ষে দেখা যায়নি। মৌসুমি শ্রমিকদের দুর্দশা প্রচারিত হওয়ায় চাপে পড়ে কেন্দ্র বিশেষ ট্রেন চালাতে রাজি হয়। কিন্তু এর ফলে সংক্রমণও বেড়ে গেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের অভিমত, ঘরে ফেরা শ্রমিকদের ৮ শতাংশ করোনা আক্রান্ত।