বিশ্বায়নের কী হাল করবে করোনা

কোভিড-১৯-এর বিস্তার ঠেকাতে গৃহীত লকডাউন পদক্ষেপের কারণে এমনই জনশূন্য হয়ে পড়েছে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর। ছবি: রয়টার্স
কোভিড-১৯-এর বিস্তার ঠেকাতে গৃহীত লকডাউন পদক্ষেপের কারণে এমনই জনশূন্য হয়ে পড়েছে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর। ছবি: রয়টার্স

দেখা হলেই হাত মেলানো কিংবা হৃদ্যতা, কিছু বেশি হলে জড়িয়ে ধরার চল নিয়ে তো এ বছরের শুরু থেকেই অস্বস্তি শুরু হয়েছে, পঞ্চম মাসের মাঝামাঝি এসে যা এখন একটি অতীত ঘটনা। এই সময়ে ঠান্ডা কি গরম দেশ ও আবহাওয়ার ভেদ না করেই মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরাটাই এখন দস্তুর। অন্তত যাঁদের সামর্থ্য আছে এসব সুরক্ষাসামগ্রী কেনা ও ব্যবহারের, তাঁদের। কোভিড-১৯ করমর্দনের মতো অনেক বিষয়কেই পুরোনো করে ছেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ থেকে শুরু করে বাজারে চালু পণ্যের পরিচয়, অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে একেবারে। ঠিক একইভাবে বিশ্বায়নকেও অতীত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে কোভিড-১৯। বিশেষজ্ঞরা অন্তত তেমনটাই বলছেন।

অবশ্য এই মহামারি শুরু হওয়ার আগে থেকেই সংকটের মুখে ছিল বিশ্বায়ন ধারণাটি। কয়েক বছর ধরেই বিশ্বায়নের মৃত্যুঘণ্টা থেকে থেকে বাজিয়ে আসছেন এ-সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা। বারবার করে সতর্ক করছেন এই বলে, এরই মধ্যে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের চলতি ধারণায় বদল আনার সময় এসে গেছে। গত দশকে আর্থিক খাতে হওয়া ধস কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই ১৯৯০-পূর্ব সময়ের মতো করে বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে দ্বৈরথ এক ধরনের সংশয়ের বীজ বুনে দিয়েছিল। এই সতর্কবার্তা একেবারে খালি চোখে চাক্ষুষ করেছে বিশ্ববাসী। আজকের কোভিড-১৯ সংকটের আগ পর্যন্ত চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথই ছিল সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয়। বিশ্বের অন্য সব অঞ্চলে হওয়া নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নড়নচড়নের পেছনেও এই দ্বৈরথের ভূমিকাই ছিল বলে মনে করা হয়। বিষয়টি অনেকটাই সোভিয়েত যুগের স্নায়ু যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এই দ্বৈরথ অনেক আগে থেকে চললেও প্রকাশ্যে সবার দৃষ্টিগোচর রকমের স্পষ্টভাবে সামনে আসে মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প বসার পর থেকেই।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথের একটি আপাতমীমাংসা হলেও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাতারাতি তাদের বসানো দাবার ছকটি হাওয়া হয়ে যায়নি। ফলে অঞ্চলগুলোয় প্রভাব বিস্তারের লড়াইটা ছিল একেবারে সামনেই। তাই যখন ডিসেম্বরে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ চীন থেকে ক্রমে ইউরোপ পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত আক্রান্ত করে ফেলল, তখন বিশ্ববাসী কান পেতে শুনল নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব; কিছু কিছু নির্মাণও করল নিজেরা। সে যা-ই হোক।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের বহু আগে থেকেই এ দুই দেশের রেষারেষির সূত্র ধরে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলো আলাদা অবস্থান নিতে শুরু করে। ফলে বিশ্বায়িত পৃথিবীর রূপের বদল হতে থাকে। এরই চরম পর্যায়টি সামনে নিয়ে এসেছে কোভিড-১৯।

বিশ্বায়িত রোগ কোভিড-১৯-এর কারণে খোদ বিশ্বায়নই এখন বিপাকে। বন্ধ সীমান্তের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের চলাচলের কথা তো বলার আর জো নেই। ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, হিথ্রো বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রী চলাচলের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৭ শতাংশ কমেছে। এপ্রিলে মেক্সিকোর গাড়ি রপ্তানি কমেছে ৯০ শতাংশ। চলতি মাসে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দিয়ে কনটেইনারবাহী যেসব জাহাজ চলাচল করার কথা ছিল, তার ২১ শতাংশই বাতিল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি মহামারির পরও বেশ কিছুদিন চলবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই সুরক্ষা ব্যবস্থা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের মগজে স্থায়ী আসন গেড়ে বসতে পারে।

এই মহামারি মানুষের চলাচলকেও রাজনীতিকীকরণের বস্তু বানিয়ে ফেলবে আগের চেয়ে বেশি। ফলে বিবদমান পক্ষগুলো পরস্পরের ওপর অলিখিত অবরোধ আরোপ করতে পারে। করোনাভাইরাস চীন থেকে ছড়িয়েছে—এমন বক্তব্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর দেশের কিছু উগ্র মানুষকে বেশ উসকে দিতে পেরেছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে চীনা অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়, এমনকি এশীয়দের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

১৯৯০ সালের পর থেকে বিশ্বায়ন যে গতিতে এগিয়েছে, তাতে পণ্যের ক্ষেত্রে সীমান্ত ধারণাটিই মুছে যাচ্ছিল। এই কাঠামোয় চীন পরিণত হয় বিশ্বের কারখানায়। একসময় বিভাজিত দেশগুলো আবার নানা জোটের নামে একত্র হচ্ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকেই কিন্তু বিশ্বায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। আর্থিক খাতের ব্যর্থতার দায় অন্য সব খাতের ওপর গিয়ে পড়ে। তারপর তা কাটিয়ে ওঠা গেলেও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ একরকম স্থবির দশাতেই ছিল। বিশেষত পশ্চিমের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি দারুণভাবে সত্য। ফলে বিশ্বায়নের গতি একরকম নেমেই গেল বলা যায়, যাকে ২০১৯ সালের শুরুতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ আখ্যা দেয় ‘স্লোবালাইজেশন’ হিসেবে।

এই স্লোবালাইজেশন প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমন। তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকেন। সীমান্ত নিয়ে এত কঠোর কোনো প্রেসিডেন্ট এর আগে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র দেখেনি। বিশ্বায়নের ব্যবস্থাপত্র বিলানো যুক্তরাষ্ট্রের এই দশা ধারণাটিকেই বিপর্যয়কর অবস্থায় ফেলে। এর মধ্যই শুরু হলো কোভিড-১৯, যা এর কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

কোভিড-১৯ ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় ঘরবন্দী থাকা ও আক্রান্ত রোগীকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা খুবই জরুরি। ফলে জনসমাগম কমানোটাও ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এরই ফল হচ্ছে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনের মতো শব্দের জনপ্রিয়তা। আর শব্দের জনপ্রিয়তা তো ক্রিয়া থেকেই আসে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই গোটা বিশ্ব অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার-হাট সব বন্ধ। চীন তার অর্থনীতিকে চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদন ও সরবরাহের মতো বিষয়গুলো দিয়ে সচল রেখেছে। তার পরও পরিস্থিতি ভয়াবহ, আর সবাই তো চীন নয়। চলতি বছর বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কমতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মে মাসের প্রথম ১০ দিনে অন্যতম বাণিজ্য শক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন অঞ্চলে এরই মধ্যে মন্দার ভয়াবহ প্রভাব দেখা দিয়েছে। এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিয়েছে কোভিড-১৯। পশ্চিমা দেশগুলো দেখছে যে তাদের স্বাস্থ্য খাত অনেকটাই অন্য দেশ থেকে আমদানি করা চিকিৎসা সরঞ্জাম ও এশিয়া থেকে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। এর যে প্রতিক্রিয়া হবে, তা একটি বিশ্বায়িত বিশ্বে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুকূল না-ও হতে পারে।

আবার যেহেতু এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাত অনুরূপ নয়, তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সীমান্ত খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এক ধরনের দ্বিধা দেখা যেতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো হয়তো নিজেদের মধ্যেই সীমান্ত আগের মতো অবারিত করবে। একইভাবে অন্য অঞ্চলগুলোতেও তুলনামূলক এগিয়ে থাকা দেশগুলো সম পর্যায়ের দেশগুলোর জন্যই তাদের সীমান্ত অবারিত করবে। এতে করে বিপাকে পড়বে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো। এটি এক নতুন প্রান্তিকরণের জন্ম দিতে পারে। এমন অবস্থায় এক নতুন ‘স্বনির্ভর অর্থনীতির’ যুগে প্রবেশ করতে পারে বিশ্ব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এরই মধ্যে এমন আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন।

অর্থনীতিবিদেরাও এমন এক বাস্তবতার কথাই বলছেন বারবার। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতা, বাজার কাঠামো, পণ্যের বিশ্বায়নের ধারণার স্থানটি নিতে পারে এক নয়া রক্ষণশীলতার ধারণা। আর তেমনটি হলে হঠাৎ করেই বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে মানবসম্পদ রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলো চরম বিপাকে পড়বে।