বাবার হত্যাকারীদের কেন ক্ষমা করলেন খাশোগির ছেলে

সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকারীদের ক্ষমা করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এল সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের নাম। ছবি: রয়টার্স
সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকারীদের ক্ষমা করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এল সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের নাম। ছবি: রয়টার্স

সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ক্ষমা করে দিয়েছেন তাঁর পরিবার। এতে করে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা (সৌদি আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড) হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল। এই ক্ষমা ঘোষণার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। এই ক্ষমা করার কারণ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

বর্তমান সৌদি যুবরাজ এবং দেশটির অঘোষিত শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানের সময়ই সৌদি আরব থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। সে সময় থেকেই ওয়াশিংটন পোস্টে তিনি নিয়মিত লিখতেন। আর এই লেখাপত্রের একটি বড় অংশজুড়েই থাকত বিন সালমানের কঠোর সমালোচনা। ফলে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে যখন তাঁকে হত্যা করা হয়, তখন থেকেই এর পেছনের কারিগর হিসেবে বারবার উঠে এসেছে বিন সালমানের নাম। আর পরে যখন হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও এর জন্য পাঠানো বিশেষ দলের সঙ্গে সৌদি যুবরাজের ব্যক্তিগত বহরের যোগের বিষয়টি সামনে এল, তখন এ বিষয়ে অনেকেই নিঃসন্দেহ হয়ে গেলেন। এই সন্দেহ নিয়ে কিছুটা যা দ্বিধা দেখা গিয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে খাশোগি হত্যার পূর্ণ তদন্ত ও যথাযথ বিচারের ঘোষণা দেওয়ার পর। লোকে ভাবল, বিন সালমান হয়তো এর সঙ্গে সত্যিই সরাসরি জড়িত নন। কিন্তু এবার খাশোগি পরিবারের পক্ষ থেকে খুনিদের ক্ষমা করার এ ঘোষণা আসার পর সে বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে।

গত ডিসেম্বরে সৌদি আদালত তদন্ত ও বিচারের পর অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে তিনজনকে কারাদণ্ড ও পাঁচজনকে শিরশ্ছেদের আদেশ দেন। অবশ্য এই আট অভিযুক্তের নাম সৌদি প্রশাসন কখনোই প্রকাশ করেনি। উপরন্তু সম্প্রতি তুরস্কের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, সৌদি আদালত এই ঘটনার অভিযোগ ও বিচার প্রক্রিয়া এমনভাবে এগিয়ে নিয়েছিল যেন অভিযুক্তদের ক্ষমা করার মাধ্যমে নিস্তার দেওয়ার পথটি খোলা থাকে। আর সেই উদ্দেশ্যই সফল করলেন খাশোগিপুত্র সালাহ খাশোগি।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সালাহ খাশোগি বাবার হত্যাকারীদের ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া টুইটার পোস্টে পবিত্র কোরআনের বাণী উদ্ধৃত করে ক্ষমার মহত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। বিষয়টি চমৎকার। কিন্তু যখন এর সঙ্গে আরও কিছু তথ্য যুক্ত হয়, তখন তা আর নিছক ক্ষমার মতো মহৎ গুণের বহিঃপ্রকাশের বিষয় থাকে না। খাশোগি হত্যার সঙ্গে সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিটির নাম জড়িত, যার সমালোচনা করার দায় জামাল খাশোগিকে শোধ করতে হয়েছে জীবন দিয়ে। শুধু তা-ই নয় বিন সালমানের ক্ষমতার সমীকরণে যাকেই উপদ্রব মনে হয়েছে, তাঁকেই হয় কারাগারে যেতে হয়েছে, নিতে হয়েছে গৃহবন্দীত্ব। এই যখন অবস্থা, তখন সৌদি আরবে অবস্থান করা সালাহ খাশোগির পক্ষে বাবার খুনিদের ক্ষমা না করার বিকল্প আর কী–ই বা হতে পারে।

হ্যাঁ, সালাহ জামাল খাশোগির একমাত্র সন্তান নন। তাঁর আরও এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সৌদি আদালত যে বিধানটি অনুসরণ করছে, সেখানে পরিবারের যেকোনো এক সদস্য ক্ষমা করলেই খুনিরা ক্ষমা পেয়ে যাবে। অবশ্য বিষয়টি এমনও নয় যে, সালাহ টুইটারে পোস্ট দিলেই খুনিরা ক্ষমা পেয়ে যাবে। এ জন্য সালাহ খাশোগিকে আদালতে হাজির হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দিতে হবে। তার আগে সালাহ খাশোগির এই ঘোষণা আদতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে এমন একটি বিষয়ের জন্য প্রস্তুত করে রাখার লক্ষ্যে।

এ বিষয়ে খাশোগি হত্যার তদন্ত কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অ্যাগনেস কালামার্ড নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বিচারের নামে করা তামাশার অংশ হিসেবে এই ঘটনাটি ঘটাচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ, যার মাধ্যমে তারা নিষ্কৃতি পাবে বলে মনে করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতারিত হওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়।’ এ জন্য তিনি সৌদি তদন্ত, বিচার ও রায়কে বিবেচনায় না নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকেই তদন্ত বিচারের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এ ক্ষেত্রে এমনকি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি আরবের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সংযোগের বিষয়টিরও পুনরুল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, মার্কিন তদন্ত সংস্থা সিআইএর প্রতিবেদনে খাশোগি হত্যার জন্য সরাসরি বিন সালমানকে দায়ী করা হয়। একই সঙ্গে মার্কিন সিনেটে খাশোগি হত্যার জন্য বিন সালমানকেই ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়ে একটি প্রতীকী প্রস্তাব পাস হয়েছিল।

এদিকে জামাল খাশোগির বান্ধবী হাতিচে চেঙ্গিস এ ক্ষমার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি। চেঙ্গিস বলেছেন, ‘তাঁর হত্যাকারীদের ক্ষমা করার অধিকার কারও নেই।’

উল্লেখ্য, চেঙ্গিসকে বিয়ের অনুমতি চাইতেই ওই দিন ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন খাশোগি। আর তারপর আর সেখান থেকে বের হয়ে আসেননি। তাঁকে হত্যার পর, তাঁর শরীর টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। কোথায় ফেলা হয়েছিল তাও কখনো জানা যায়নি।

একই মত দিয়েছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সৌদি মানবাধিকার সংস্থা এএলকিউএসটির প্রধান ইয়াহিয়া আসিরি। এক টুইটার পোস্টে তিনি বলেন, ‘জামাল খাশোগির হত্যা কোনো পারিবারিক ঘটনা নয়। অন্য কোনো ঘটনার সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই কর্তৃপক্ষ তাঁকে হত্যা করেছে। এটি রাজনৈতিক ঘটনা।’

এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদন আল-জাজিরা জানায়, ইয়াহিয়া আসিরিসহ সৌদি আরবের বেশ কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিক এই ক্ষমার ঘোষণাকে খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁদের মত হচ্ছে, খাশোগি হত্যা সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক ঘটনা। এটি কোনোভাবেই কোনো পারিবারিক ঘটনা নয়। তিনি রাজনৈতিক মত নিয়ে লেখালেখি করতেন।

জামাল খাশোগির হত্যা সারা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এমন এক হত্যার পর ভুক্তভোগীর পরিবারই খুনিদের ক্ষমা করে দিচ্ছে—এমন কথা শোনার জন্য আসলে বিশ্ববাসী প্রস্তুত নয়। উপরন্তু ঘটনাটি এমন সময় ঘটল, যখন মুসলিম বিশ্ব রমজান শেষে ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। তাই এর পেছনে নানা উদ্দেশ্য-বিধেয়র খোঁজ করা হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে দুটি তত্ত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমটি তো সৌদি সংবাদমাধ্যমসহ তার মিত্র দেশগুলোর অনুগত সংবাদমাধ্যম বলে বেড়াচ্ছে। আর তা হলো—জামাল খাশোগির ছেলে সালাহ খাশোগি তাঁর বাবার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এই একটি কথাই বারবার প্রচার করে বিষয়টিকে সহজ ও স্বাভাবিক করে তোলার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিন্তু চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় তত্ত্বটিও কিন্তু সামনে চলে আসছে। আর তা হলো—এই সালাহ খাশোগিই কিন্তু বিন সালমানের কাছ থেকে সরাসরি সহানুভূতি গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য তেমনটা না করেও তাঁর উপায় নেই। কারণ তিনি সৌদি আরবেই থাকেন। আর জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ কে করবে? একই সঙ্গে সালাহ যখন ক্ষমা করলেন তখনো কিন্তু অভিযুক্তদের কাকে কাকে ক্ষমা করলেন, সে বিষয়ে একটি বাক্যও তিনি বললেন না। বলবেন কীভাবে? কারণ, আজ পর্যন্ত বিচারের মুখোমুখি হওয়া ১১ জন, চূড়ান্তভাবে অভিযুক্ত আটজন কিংবা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের কারও পরিচয়ই প্রকাশ করা হয়নি। তাই এখনো পর্যন্ত কেউ জানেই না আদতে কী তদন্ত হয়েছে, তদন্তে কী তথ্য পাওয়া গেছে, কারা জড়িত ছিল, কোন মাত্রায় জড়িত ছিল। এমনকি আদৌ কোনো তদন্ত হয়েছিল কিনা, সে সম্পর্কেও সবাই অন্ধকারেই রয়েছে। তাই সৌদি কর্তৃপক্ষ, তথা অঘোষিত শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের রক্তচক্ষুই এই মহান ক্ষমার ঘোষণার নির্মাতা—এমন জল্পনাকে উড়িয়ে দেওয়ার তেমন সুযোগ নেই।