কোভিড-১৯: আক্রান্ত চিকিৎসকের সুস্থ হওয়ার রোজনামচা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

৯ মার্চ আমাদের হাসপাতালে প্রথম কোভিড ওয়ার্ড চালু হলো। চিকিৎসকদের ডিউটি পুনর্বিন্যাস, সবাইকে রোটেশনে রেড-ওয়ার্ডে কোভিড রোগী দেখতে হবে।

১৩ মার্চ কোভিড ওয়ার্ডে এক নারীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। দেখতে গেলাম। সার্জিক্যাল মাস্ক, ডিসপোজেবল গ্লাভস আর প্লাস্টিকের এপ্রোনই সম্বল।

১৫ মার্চে নাইট ডিউটি। একজন কোভিড রোগী মারা গেছেন। ডেথ ভ্যারিফাই করতে দেরি হচ্ছে। ডাক পড়ল। ৫-৭ মিনিট লাগল মৃতদেহ পরীক্ষায়।

২৩ মার্চ ওয়ার্ডে এসে দেখি এক ডিমেনশিয়া রোগী হেঁটে বেড়াচ্ছেন, কিছুতেই বিছানায় বসেন না। সার্জিক্যাল মাস্ক পরা চিকিৎসক-নার্সদের গায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়, আমার কাছেও। পরদিন জানা গেল তিনি কোভিড পজিটিভ। তাকে মাস্ক পরানো হলো। ওয়ার্ডে যথারীতি হাঁটেন, টেনে টেনে মাস্ক নামিয়ে ফেলেন।

২৫ মার্চ কাজ করতে করতে দুটো কাশি দিলাম। সহকর্মীরা ঘুরে তাকাল, সরি বললাম। বাসায় ফিরে রাতে কাশিটা একটু বাড়ল। ঘুমে সমস্যা হলো। কিন্তু জ্বর নেই।

২৬ মার্চে সকালে হাসপাতালে সহকর্মীদের বললাম, রাতে কাশির জন্য ঘুম হয়নি। ওরা হইহই করে উঠল, নতুন কাশি, বলো কী? হাসপাতালে এলে কেন? এক্ষুনি বাসায় যাও। জিজ্ঞেস করলাম, কোভিড টেস্ট করা যাবে কি না। না, ওগুলো ভর্তি রোগীদের জন্য। চিকিৎসক–নার্সরা আইসোলেশনে যাবে। ১১১-এ ফোন দিলাম-আইসোলেশনে যাও। অকুপেশন হেলথকে ফোন দিলাম, আইসোলেশনে যাও। হেলথ কেয়ার ওয়ার্কারদের টেস্ট চালু হয়নি।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

২৬ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বেশ কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, বড় টয়লেট হচ্ছে ৪-৫ বার। দিনে তিনবার লবণ পানির গড়গড়া, তিন-চারবার মেনথলযুক্ত ওলবাস ওয়েল দিয়ে নাকে ভ্যাপার নেওয়া, দুটো থার্মোফ্লাক্সে লেবু-আদাসহ গরম পানি রেখে কিছুক্ষণ পরপর চুমক দেওয়া, লেমন গ্রিন টি, প্যারাসিটামল ৬ ঘণ্টা পরপর, মেনথলযুক্ত স্ট্র্যাপসিল, ভিট সি, ভিট ডি, মাল্টিভিটামিন, প্রচুর ফল ও পুষ্টিকর খাবার। প্যারাসিটামল ছাপিয়ে তাপমাত্রা ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। বেশি না। তবু ঘরে একটা অ্যান্টিবায়োটিক ছিল, খাওয়া শুরু করলাম। লম্বা-শ্বাসের ব্যায়াম চলছে। লাইন ম্যানেজার, জিপি ও ১১১-এ আবার ফোন দিলাম। টেস্ট করার উপায় নেই।

৩১ মার্চ রাত আড়াইটা। চোখে ঘুম নেই কয়েক দিন। ঘুমের সহায়তার জন্য Lavender spray করলাম বালিশে। কোনো গন্ধ নেই। উঠে তিনটা পারফিউম চেক করলাম, লেবু, কমলা ঘষে শুঁকলাম, কেকের ভ্যানিলা এসেন্সটাও...নাহ্ কোনো গন্ধ নেই। কোভিডের ভয় হলো, অস্ট্রেলিয়ায় বোনকে ফোন দিলাম৷ বোন সাহস দিল।

১ ও ২ এপ্রিল নাক ও সাইনাস খুবই কনজেসটেড। নাকে অদ্ভুত বাজে গন্ধ। মুখে স্বাদ নেই। জিব তেতো, জোর করে খেতে হবেই। মাথাব্যথা, diziness চলছেই।

৩ থেকে ৭ এপ্রিল বুকের নিচের দিকে ব্যথা। বিছানা থেকে উঠে কিছু করতে গেলে দম বেরিয়ে যেতে চায়। নিউমোনিয়া চাই না। অ্যান্টিবায়োটিক চলুক।

৭ থেকে ১৩ এপ্রিল ক্রমাগত মাথাব্যথা ও খুব বেশি দুর্বলতা। একদিন পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, কোনোমতে রক্ষা পেলাম।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

১৪ ও ১৫ এপ্রিল প্যারাসিটামল আর লাগছে না। কোনো ব্যথা নেই। নাকে গন্ধ অনেকটাই ফিরে এসেছে। মুখটা এখনো তেতো।

১৬ এপ্রিল গোড়ালির ওপরে দুপায়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে বেশ চুলকানি। অথচ কোনো rash নেই। ক্রিম লাগাই, অ্যান্টিফাংগাল লাগাই, কমে না। গুগল করে দেখি একটা নিউজ করেছে ‘কোভিডের তিনটি নতুন উপসর্গ’ তার মধ্যে চুলকানি একটি!

১৭ এপ্রিল কাজে যোগ দিই। যদিও কেমন যেন আগের মতো জোর নেই শরীরে। বাসায় ফিরে হালকা ব্যায়াম শুরু।

১৭ এপ্রিল থেকে ১৯ মে নিয়মিত কাজে হাসপাতালে যাওয়া হয়েছে।
পুরোপুরি সব ধরনের উপসর্গমুক্ত হতে ও দুর্বলতা কাটাতে ৫-৬ সপ্তাহই লেগেছে।

২০ মে প্রাইভেট অ্যান্টিবডি টেস্ট করলাম। করোনা অ্যান্টিবডি পজিটিভ! হুম...কোভিডই তাহলে!
এটাই আমার কোভিডের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ছোট রোজনামচা।

পুরোটা সময় বোনেরা, ভাইয়ের বউ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা, কমরেডরা ফোন করে, ফেসবুকে, ওয়াটসঅ্যাপ/মেসেঞ্জারে খোঁজ নিয়েছে, সাহস দিয়েছে। গ্রোসারি ঘরে দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সবার সহযোগিতায় ঘরে থেকেই করোনা জয় করতে পেরেছি। সবাইকে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।

*লেখক: চিকিৎসক, এসেক্স, যুক্তরাজ্য। [email protected]