করোনাকালে খাদ্যসংগ্রামের গল্প

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

দুই মাস পর ছোট বোনকে নিয়ে প্রথম বাসার বাইরে পা বাড়লাম। গন্তব্য, স্থানীয় এটিএম বুথ। ঘরে কোনো নগদ টাকা নেই। মালয়েশিয়ায় এখন কাঁচা বাজার হতে শুরু করে প্রায় সবকিছু অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে চলছে। তবু হাতে কিছু টাকা রাখা দরকার।


এই মুহূর্তে কেমন আছি? বেশ ভালোই আছি। তবে শুরুতে অবস্থা ছিল কঠিন। গত সেপ্টেম্বর মাসে চলে এসেছিলাম স্বামী, পরিবার রেখে ছোট বোনকে নিয়ে কুয়ালালামপুরে। বোন সাইকোলজি বিষয়ে স্নাতক শুরু করল আর আমি আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে স্নাতকোত্তর। বেশ ভালোই কাটছিল দিন। 


দেশে গেলাম ছুটিতে, ফিরলাম ১ মার্চ। ফিরেই কিছুদিন পর শুনি মালয়েশিয়ায় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, ক্লাস্টার আমার বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরের এক তাবলগি মসজিদ। ২০ হাজার মুসল্লির এই জামাত অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। মালয়েশিয়ার ৪০ শতাংশ সংক্রমণ এই তাবলিগ জামাত থেকেই।


আশঙ্কা বাড়তেই থাকে। বোনের ক্যাম্পাস বাসার কাছে হলেও আমারটা প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। ট্রেন, বাস মিলিয়ে যেতে হয়। ভালোভাবে মাস্ক পরে বের হই। বারবার হাত স্যানিটাইজ করি। এরপরও ভয় কাটে না কারণ প্রতিদিন গণপরিবহন ব্যবহার করতে হচ্ছে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য।


দেশ থেকে মাত্র ফেরার কারণে টাকাপয়সা অল্প। সেটা দিয়েই দ্রুত প্রায় দুই সপ্তাহের বাজার করলাম। তখনো অতটা কেউ গুরুত্ব দিচ্ছিল না। গুরুত্ব দেওয়া শুরু করল, যখন সরকার এমসিও (মুভমেন্ট কনট্রোল অরডার) অথবা লকডাউনের আদেশ দিল। সবাই যখন হুমড়ি খেয়ে বাজার করছে আমি, তখন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত। আমাদের সিঙ্কাপুরি হাউসমেটরা এক দিনও অপেক্ষা না করে নিজেদের দেশে চলে গেল।


এর মাঝেই একদিন মনে হলো বাজারগুলো থাকা অবস্থায় অনলাইনে বেশি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অর্ডার করে রাখি আগেভাগেই। ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখি পরবর্তী ১০ দিন এর আগে কোন স্লট খালি নেই। আমি মনে মনে একটা হিসাব করে দেখলাম যা বাজার আছে টেনেটুনে ১০ দিন হয়ে যাবে। সব বেশি বেশি অর্ডার করে ফেললাম।


১০ দিন পার হওয়ার পর ডেলিভারির তারিখ এল কিন্তু ডেলিভারি এল না। কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলাম। কোনো সাড়া নেই। পরদিন যথারিতি আবারও কল করলাম। বলল অপেক্ষা করতে হবে, ডেলিভারির অনেক চাপ, বলতে পারছে না কবে আমার ডেলিভারি দিতে পারবে। তবে আশা করছে একদিন এর ভেতর পেয়ে যাব। পরের দিন আবার কল করলাম। বলল যাদের অনেক জিনিস তাদের অর্ডার অটোমেটিক বাদ হয়ে যেতে পারে কিন্তু তোমারটা সার্ভারে দেখাচ্ছে বাদ হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কী করব? আবারও একই উত্তর, অপেক্ষা করতে হবে।


শঙ্কা বাড়তে লাগল কারণ খাবার প্রায় শেষ, পানির ফিল্টার নষ্ট। বড় পাতিলও নেই পানি ফোটানোর জন্য। ইতিমধ্যেই চাল-ডাল আছে অল্প, মাছ–মাংস, খাবার পানি, তেল, ডিম, শাকসবজি, ফলমূল শেষ, পেঁয়াজ–রসুন আছে একটা–দুইটা, আছে অল্প কিছু পাস্তা।


এক দিন–দুই দিন দিন পার হতে লাগল, প্রতিদিনই কাস্টমার কেয়ারে কল করতে লাগলাম এবং তারা বলল অপেক্ষা করতে। আমাদের নিচে একটা ছোট দোকান আছে কিন্তু ভয়ে নিচে নামতে পারছিলাম না। আশপাশের অনেক কনডোমিনিয়াম এ সংক্রমণের কথা শোনা যাচ্ছিল। এই অবস্থায় নামার সাহস হয়নি।


১০ দিন পার হয়ে যাওয়ার তিন দিনের দিন ফেসবুকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি পোস্ট দেখতে পেলাম। তারা আটকে পড়া বাংলাদেশিদের খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে আবেদন করে দিলাম। মনে হচ্ছিল, ডেলিভারির আশায় বসে থাকলে হয়তো না খেয়েই...।


এ কয়দিন কী কী খেয়েছিলাম, তার বিশদ বর্ণনা দিতে চাচ্ছি না। পানি খেতাম কলের পানি কেতলিতে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে। একদিন কিচ্ছু না পেয়ে হাউসমেটদের ফ্রিজে হানা দিলাম। তাদের ফ্রিজেও কিছুই ছিল না, বেশির ভাগেরই মেয়াদ চলে গিয়েছিল। ডিপ ফ্রিজে একজনের এক পিস মুরগির বুকের মাংস পেয়ে ঘরের শেষ পট চাল এবং একটা পেঁয়াজ দিয়ে মেখে খিচুড়ি–জাতীয় একটা খাবার রেঁধে ফেললাম। হাতে অল্প কিছু টাকা ছিল সাহস করে নিচের দোকানে নামলাম চার দিনের দিন। খেয়ে বাঁচতে হবে তো। সেই দোকান আবার অনলাইনে পেমেন্ট নেয় না, আমি জানতাম। তাই অল্প কিছু নগদ টাকা নিয়ে নুডলস, দুধ, পানি আর এক কেজির মতো চাল কিনে আনলাম।


আমাদের ডেলিভারি আসল ডেলিভারির দিন হতে সাত দিন পর। পাঠক হয়তো ভাবছেন এই সাত দিনেরই তো কষ্ট। আসলে আমাদের অধিকাংশ ডেলিভারিই এল না। মাংস দিল পচা। তেল এল, চাল এল না। এমন প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ জিনিস এল না।


আল্লাহর অশেষ রহমতে এই অসম্পূর্ণ ডেলিভারি পাওয়ার দুই দিনের মাথায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের খাদ্যসহায়তা পেয়ে গেলাম। এখানে বলে রাখা ভালো ডেলিভারি এবং খাদ্যসহায়তা মিলে শুকনো খাবার ছাড়া কোনো মাছ মাংস কিংবা শাকসবজি/ফলমূল পাইনি। এগুলো জোগাড় করা হয়ে উঠল নতুন সংগ্রাম।


ফেসবুকে কিছু মালয়েশিয়ান খাবার ডেলিভারির গ্রুপ খুঁজে পেলাম। মাছ–মাংস, শাকসবজি বিক্রি করছে আমাদের এলাকায় এমন কিছু পোস্ট খুঁজে পেয়ে অর্ডার করে দিলাম। দ্রুতই ডেলিভারি পেয়ে গেলাম। শেষ হলো দুই বোনের প্রবাসে করোনাকালীন খাদ্যসংগ্রাম।


এ রকম হাজারো গল্প ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে। হয়তো একদিন করোনা থাকবে না, তবে করোনা–কালের এসব স্মৃতি অম্লান থাকবে। কীভাবে এক ভাইরাস পুরো পৃথিবী ওলটপালট করে দিল, তা কি এত সহজে ভোলার?

*লেখক: ব্যারিস্টার-এট-ল।
[email protected]