পিউ রিসার্চের জরিপ: চীনের প্রভাব কমবে, আশায় মার্কিনরা

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের চিন্তার জগতেও ছাপ ফেলে যাচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারি। নতুন করোনাভাইরাস মহামারির পরের বিশ্বকাঠামোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন মার্কিনরা। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক তিন জরিপের তথ্যমতে, মার্কিনরাও বৈশ্বিক নেতৃত্বে পরিবর্তনসহ নানা ধরনের বদলের আশা দেখছেন।

করোনাভাইরাস-পরবর্তী বিশ্বের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিনরা একেকজন একেক ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অধিকাংশই বৈশ্বিক নেতৃত্বে নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি, নতুন ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও এর বাইরে বিভিন্ন দেশে নতুন ধরনের অস্থিরতা দেখা দেবে বলে মত দিয়েছেন। সাম্প্রতিক জরিপে উল্লিখিত বিষয়গুলোয় একেকজন একেক অভিমত দিলেও বৈশ্বিক মঞ্চে চীনের অবস্থান নিয়ে কমবেশি সবাই অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। অধিকাংশের চাওয়া হচ্ছে, মহামারি-পরবর্তী পৃথিবীতে চীনের প্রভাব কমে আসুক।

মহামারির পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের প্রকরণ কী হতে পারে, তা নিয়ে পিউ রিসার্চ সেন্টার প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিনদের মধ্যে জরিপ চালিয়েছিল। এতে যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে তা হলো—

১. চীনের প্রভাব কমে আসবে

নতুন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীন যথাযথভাবে সাড়া দিতে পারেনি বলে মনে করে অধিকাংশ আমেরিকান। তাদের মতে, এ কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে চীনের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের বেশি মনে করে, মহামারি-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চীনের প্রভাব কমবে। ৩১ শতাংশ মনে করে, চীনের প্রভাব একই রকম থাকবে। তবে ১৭ শতাংশ রয়েছে, যারা মনে করে মহামারি-পরবর্তী সময়ে চীনের প্রভাববলয় উল্টো বাড়বে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে দলীয় অবস্থানের দিক থেকে এ ক্ষেত্রেও বিভাজন রয়েছে। রিপাবলিকান বা রিপাবলিকান ভাবধারার স্বাধীন ব্যক্তিরা চীনের বিষয়ে নেতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মহামারি-পরবর্তী সময়ে চীনের প্রভাব বাড়বে বলে মনে করেন যারা, তাদের মধ্যে রিপাবলিকান মনোভাবাপন্নের চেয়ে ডেমোক্র্যাট ভাবধারার মানুষ অনেক বেশি। তবে এ ক্ষেত্রেও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ঐক্য নেই।

মার্কিনদের চোখে চীনের সামরিক শক্তিরও অবনমন হয়েছে। মাত্র ৬ শতাংশ মার্কিন এখন চীনকে শীর্ষ সামরিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ ২০১৬ সালেও এ সংখ্যা ছিল জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১২ শতাংশ। তবে ৩০ শতাংশই চীনকে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীনকে হুমকি মনে করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৮ সালের পর থেকে এ সংখ্যা ১৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে।

২. যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতায় কোনো প্রভাব পড়বে না

করোনাভাইরাস মহামারি শেষ হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাব একই থাকবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন অধিকাংশ মার্কিন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪১ শতাংশই মনে করেন, মহামারির আগের মতোই মহামারির পরও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব একই থাকবে। বাদবাকিদের মধ্যে ২৯ শতাংশ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়বে। আর বাকিরা মনে করে, এই প্রভাব কমবে।

মহামারি-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়বে—এমন মত মূলত রিপাবলিকান বা রিপাবলিকান মনোভাবাপন্নদের। এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান তুলনামূলক আলাদা। বলা যায় একেবারে বিপরীত। অধিকাংশ ডেমোক্র্যাট বা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতি সদয় স্বাধীন ভোটারের দৃষ্টিতে মহামারি–পরবর্তী বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্রকে বাকি সব দেশ থেকে সেরা মনে করা লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গত বছর সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে শীর্ষ দেশ মনে করা লোকের সংখ্যা ছিল জরিপে অংশ নেওয়াদের ৫০ শতাংশ। এবারের জরিপে এ হার বেড়ে ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সেরা মনে করছে ৮০ শতাংশ লোক, যেখানে ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৭২ শতাংশ। শুধু তা–ই নয়, জরিপে অংশ নেওয়াদের প্রায় সবাই মনে করে, চীন নয় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই বিশ্ব ভালো থাকবে।

৩. ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব অপরিবর্তিত থাকবে

মহামারির মধ্য দিয়ে যাওয়া মার্কিনদের একটি বড় অংশেরই আশা হচ্ছে মহামারির পরও বিশ্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রভাব আগের মতোই থাকুক। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অর্ধেকেরই বেশি মনে করে, মহামারির পরও বিশ্বে ইইউর প্রভাববলয় আগের মতোই থাকবে। তবে অংশগ্রহণকারীদের ২০ শতাংশ মনে করে, এ প্রভাববলয় বাড়বে। ঠিক একই পরিমাণ মানুষ অবশ্য প্রভাবের অবনমনের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব কমুক এই চাওয়া বলার অপেক্ষা রাখে না যে রিপাবলিকান বা রিপাবলিকানঘেঁষা লোকদের বেশি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বিপরীতে ডেমোক্র্যাট ও ডেমোক্র্যাট-মনোভাবাপন্ন স্বাধীন ভোটারদের মধ্যে ইইউর প্রভাব বাড়তে পারে এমন মত দেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা বেশি। তবে এই আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ ইউরোপকে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে।

৪. বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আশা

আন্তর্জাতিক পরিসরে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে এমনকি জরিপেও একমত হতে পারেনি মার্কিনরা। দেশটির নেতৃবৃন্দের মতোই এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষও বিভাজিত। পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৫ শতাংশই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে অর্থাৎ মহামারি–পরবর্তী বাস্তবতায় বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করেছেন। ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন ২৯ শতাংশ মানুষ। তাঁদের মতে, মহামারি-পরবর্তী সময়ে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়াই হবে কাজের কথা। আর ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, মহামারির আগে কিংবা পরে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

এই মহামারি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে কি করবে না, তা নিয়ে মার্কিনদের মধ্যে সুস্পষ্ট মতবিরোধ থাকলেও অধিকাংশই মনে করে মহামারি-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি অন্য দেশের সঙ্গে এক হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে, তবে অনেক সমস্যারই সমাধান হওয়া সম্ভব। এই মত ব্যক্ত করেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬২ শতাংশ। একইভাবে ৬১ শতাংশ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিজের স্বার্থ শুধু নয়, অন্য দেশের চাওয়াকেও বিবেচনায় নেওয়া।