বালিশে স্বপ্নের দাগ ধুয়ে গেছে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

‘এই জীবন ছিল নদীর মতন গতিহারা/ তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।’ গানটা শুনলেই ভাবি, হয় গীতিকার কোনো ভুল করেছেন, নয় কোনো গূঢ় অর্থ রেখে গানটা লিখেছেন। নদী তো গতিহারা হওয়ার কথা নয়। উৎস থেকে মোহনা অবধি গতিই তার ধর্ম। কিন্তু আজ করোনাকালে নিজের জীবনযন্ত্রণায় উপলব্ধি করি নদীর গতিহীন হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা।

নদী তো জীবনেরই রূপক। উত্থান–পতন, বাধা-বিপত্তি, দুপাশের হাসিকান্না কলকোলাহল সাক্ষী রেখে চলতে চলতে জীবন আর নদী দুইয়ে মিলে একাকার। জীবনের এই ছন্দকে বন্ধ করে দিলে বাঁচার সব অর্থই শেষ হয়ে যায়।

সে রাতের কথা কোনো দিনই ভুলব না, যেদিন জীবনের ছন্দ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২৪ মার্চ রাত ৮টা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমার বাড়িতে মা ট্রানজিস্টার শিয়রে রেখে শুনছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ খবর হলে মা ট্রানজিস্টার চালিয়ে শোনেন। বৈঠকখানার দেয়াল টিভির ওপর তাঁর বিশ্বাস আজকাল একটু কম। মিনিটে এক শটা খবরে তিনি খেই রাখতে পারেন না। টক শোকে বলেন কলতলার ঝগড়া। রোজই হয় আবার পরদিন সকালে একগাল হেসে খোশগল্প। দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে ভেবে ভাষণ শুনতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রধানমন্ত্রী গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, করোনা মোকাবিলায় দেশের স্বার্থে ২১ দিনের জন্য লকডাউন রাখতে হবে। কোনোভাবেই রাস্তায় বেরোনো যাবে না। ভাই পাশের ঘর থেকে বলল, এ নাকি একধরনের কারফিউ। শুনে মাথায় বাজ পড়ল। সারা দিন পথে পথে থাকা মানুষ আমি তিন সপ্তাহের জন্য গৃহবন্দী!

অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী কেনার জন্য যেদিন ছাড় পেলাম, সেদিন রাস্তায় বেরিয়ে দেখি পথ প্রায় জনহীন। যানবাহন কিছুই নেই। ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে জানালার শিকে গাল লাগিয়ে আতঙ্কিত চোখগুলো আমাকে দেখছে। একমাত্র ওষুধের দোকান আর কয়েকটা ভুসিমালের দোকান খোলা। মানুষ মুখে মাস্ক লাগিয়ে দূরত্ব মেনে চাল ডাল কিনছে। গলিগুলোর ভোতর সবজিওয়ালারা সামান্য সামান্য সবজি নিয়ে বসেছে। চোখে মুখে একটা ভয় কী জানি কখন পুলিশ আসে। বড় বাজারটা সিল করে দেওয়ায় এরা সবাই ছিটকে গেছে। এখন তাঁদেরও কোনো স্থায়ী দোকান নেই। সড়কের মোড়ে মোড়ে পুলিশ বসে আছে। মাঝেমধ্যে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশের গাড়ি যাচ্ছে। মানুষ সড়ক থেকে ছুটে এসে গলির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। একটা আতঙ্কময় পরিবেশ। বেশিক্ষণ এ পরিবেশে বাইরে থাকা যায় না। রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেও অন্য কারণে নিজেকে খুব অসহায় অসুরক্ষিত মনে হয়।

সপ্তাহখানেক পর আবার মেইন রোড ধরে হাঁটছি। মুখে মাস্ক, হাতে বাজারের ব্যাগ, মাথায় ছাতা। মোড়ে বসে থাকা পুলিশ মানুষকে আটকে রাস্তায় নামার কারণ জানতে চাইছে। যাদের গলায় পাস ঝোলানো আছে তাঁদের ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখছে। সাইকেল ঠেলা রিকশা দেখলে লাঠি মারছে। এরই মধ্যে এক বুড়ো রিকশাওয়ালা তাড়া খেয়ে গলির ভেতর এসে ঢুকল। খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর জোরে চালিয়ে আসতে, হাঁপাচ্ছে। মুখের গামছাটার জন্য শ্বাস নিতে বোধ হয় আরও কষ্ট হচ্ছে। মুখে বেঁধে রাখা গামছাটা খুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এদিকে আসছে। গালভর্তি পাকা দাড়ি, পরনের কাপড়টা নোংরা, চোখ দুটো গর্তে। নিশ্চয়ই খুব মজবুরিতে রিকশা নিয়ে পথে বেরিয়েছেন। মনটা কান্নায় ভিজে গেল। না, ওকে একটা সাহায্য করতেই হবে। আমি যদি এমনি এমনি ওর হাতে একটু টাকা গুঁজে দিই তাহলে সে হয়তো নেবে না। নেবেইবা কেন, সে তো শ্রমজীবী, ভিক্ষাজীবী নয়। করোনাকালের এই দুর্দিনে অনেকেই বাঁচার জন্য পেশা বদলেছে। সে তো বদলায়নি। হাতের ইশারায় রিকশা থামিয়ে চেপে বসলাম। এখান থেকে আমার বাড়ি মাত্র ১০ টাকার ভাড়া। রিকশায় বসে বসে তাঁর ছেঁড়া গেঞ্জিটা দেখছি। ঘেমে শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। ছেঁড়া গেঞ্জির ফাঁকে একটা কালশিটে দাগ। প্রশ্ন করতেই বলল, দুই দিন আগে পুলিশ মেরেছিল। করোনাকালে সব দেশেই ভাত দেওয়ার মুরোদ না থাকা কিল মারার গোসাঁইদের পোয়াবারো হয়েছে। করোনা শুধু শ্রমজীবীদের আর্থিকভাবেই দেউলিয়া করেনি তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারেও থাবা বসিয়েছে।

‘এত মার খেয়েও কেন বেরিয়েছ?’

প্রশ্ন শুনে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘কী করব বাবু? ঘরে বউ আর মেয়ে আছে। জামাই ছেড়ে দেওয়া মেয়েটার আট মাসের একটা বাচ্চাও আছে। আজ দুদিন থেকে ঘরে একদানাও চাল নেই। পরিবারের কষ্ট যে আর দেখা যাচ্ছে না।’

‘কেন, ত্রাণ পাওনি? এত এত সামাজিক সংগঠন, নেতা, পাতিনেতা ত্রাণ দিচ্ছে, তুমি খবর পাওনি?’

একটু হেসে বলল, ‘বাবু তাঁরা সেখানে যায় যেখানে একসাথে অনেক গরিব থাকে। লম্বা লাইন হয়, কাগজের বাবুরা আসে ফটো বেরোয়। আমি তো এক কারখানা পাহারা দেবার শর্তে সেখানে পরিবার নিয়ে থাকি। আমি ভেতরে মরে থাকলেও কেউ বলতে পারবে না।’

কথাগুলোর মধ্যে প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই, রাষ্ট্রের অবহেলা, সামাজিক ভন্ডামির কুৎসিত ছবিটা জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল। রিকশা থেকে নেমে একটা এক শ টাকার নোট হাতে ধরিয়ে হনহন করে গলির ভেতর ঢুকে গেলাম। ঘুরে দেখি সে ছলছল চোখে একবার আমার দিকে দেখছে আর একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে টাকাটা মাথায় ছোঁয়াচ্ছে। জানি না সে কিছু বুঝতে পারল কি না! জানি না সেই রিকশাওয়ালা আর পথে নেমে নুয়ে নুয়ে রিকশা টানতে পারে কি না! এও জানি না ক্ষুধা আর পিঠের অসহ্য ব্যথায় তাঁর রাত শেষে ভোরের সকাল আসে কি না। আজ মাস দুই পরও সেই মুখটা ভুলতে পারি না।

ভাবছি করোনা না থাকলেও কি এই মানুষগুলো খুব সুখে ছিল? তাঁদের গোলাভর্তি ধান ছিল? উৎসবে নতুন কাপড় ছিল? অসুখ হলে পথ্য কেনার পয়সা ছিল? না, কখনোই নয়। কিন্তু গায়ে–গতরে খেটে কোনোক্রমে সংসারটা টেনে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। উত্থান–পতনে, উজান–ভাটিতে বয়ে যাওয়ার পরিসর ছিল। তাঁদের কাছে বাস্তব হয়তো খুব একটা সুখের ছিল না, কিন্তু একটা স্বপ্ন ছিল, কায়িক পরিশ্রম করে বেঁচে থাকার। ঘুম থেকে উঠে বালিশে স্বপ্নের দাগ রেখে কাজের সন্ধানে পথে নামার। করোনা এই স্বপ্নটুকুও কেড়ে নিয়েছে। বালিশে স্বপ্নের দাগ ধুয়ে দিয়েছে। জীবননদীটা গতিহীন দিশাহীন হয়ে গেছে।

* শিলচর, আসাম, ভারত