নিজের আপন সৌরজগৎ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
অলংকরণ : আরাফাত
অলংকরণ : আরাফাত

আঙুলগুলো আজকে চিবিয়ে খেয়েই ফেলব। দাঁত কিড়মিড় করছে। ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় নবাবপুত্রের খানাপিনার পাট চুকিয়ে টেলি-কন্সফারেন্স ধরতে হবে। হোম অফিস চলছে আজকে দেড় মাস। হোমের ভেতর অফিস ঢুকে যাওয়ার পর থেকে জীবন অতিষ্ঠ। ঘরকন্না আর চাকরি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি। এই লক্ষ্মী হয়ে হাঁড়ি ঠেলো, তো পর মুহূর্তেই সরস্বতী সেজে রিসার্চ নিয়ে ভাবো রে। তার ওপরে শিশু পালন তো আছেই। অন্য সময় হলে শিশুর বাবার কাছ থেকে কিছু সাহায্য মেলে। সে সুযোগ নেই এখন। করোনাকে চোখ রাঙিয়ে সপ্তাহের সব দিনই তাকে অফিস যেতে হচ্ছে। সুতরাং একাই দশভুজা দুর্গা হয়ে দশ দিক সামলাতে গিয়ে আমার মেজাজটা আজকাল মা কালীর মতো সপ্তমে চড়ে থাকে। চোখা একটা ত্রিশূল হাতে বাড়ির লোকদের তাড়া করতে পারলে খুব শান্তি পেতাম।

আর বাড়ির লোকেরাও বটে। এই যেমন ছেলেটা। সেই যে তখন বিশাল এক পোটলা খাবার মুখে ঢুকিয়ে গালটাকে উইয়ের ঢিঁপি বানিয়ে বসে আছে, আর গেলার নাম নেই। বন্ধ চোখে তার মৌনি সাধুর ধ্যান। গিলে খেয়ে নিলে সাধনা ফুরিয়ে যাবে, এই ভয়ে গালে জিইয়ে রেখেছে। এভাবে চলতে থাকলে সাধু বাবার আঙুলও কামড়ে দিতে পারি। সাধু বাবার নাম তাফসু মিয়া। বয়স পাঁচ হয়ে সারেনি। কিন্তু সারাক্ষণ আমাকে সাপের পাঁচ পা দেখাতে থাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাহানা দেখার সময় নেই হাতে। কোনোমতে খাদ্য পর্ব চুকিয়ে তাকে খেলতে পাঠিয়ে দিয়ে কিচেনেরই ছোট্ট টেবিলে ল্যাপটপ টেনে বসলাম।


জুম লিঙ্কটা টিপে দিতে কাটিয়ার হাসি মাখা চেহারা ভেসে উঠল। কাটিয়া আমার বস। এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথলজি বিভাগের হেড। এক নামে তাকে মিউনিখের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই চেনে। জাঁদরেল বিজ্ঞানী। করোনার ভেতর আমাদের হোম অফিসে পাঠিয়ে দিলেও নিজে প্রতিদিনই অফিসে যাচ্ছে, ল্যাব সামলাচ্ছে। টেলি–কনফারেন্সে আজকে আরও একজন যোগ দিয়েছে। প্রফেসর ডাক্তার রালফ্ হুস। আউগসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ষাট পেরোনো শান্ত, সৌম্য চেহারা। একই সঙ্গে হাসপাতালের ডিজিটাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান, আবার নামী গবেষকও বটে। তার সঙ্গে মিলে আমরা একটা কোম্পানির সঙ্গে ক্যানসারের ওপর নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করব।


কিন্তু আলোচনা শুরু করব কী, অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, প্রফেসর হুস্ আর কাতিয়া হাঁ করে কী যেন দেখছে আমার ঘাড় ডিঙিয়ে। 'অ্যাই, ওটা কী ঝুলছে ওখান থেকে?' তাদের দৃষ্টি বরাবর তাকিয়ে একেবারে মরমে মরে গেলাম। রান্নাঘরের আংটায় এবড়োখেবড়ো এক ফালি কাপড় ঝুলছে। সনাতনী রান্নাঘরীয় ভাষায় যাকে বলে 'ত্যানা'। বাঙালি হেঁশেলের অবিচ্ছেদ্য অপরিহার্য অংশ। জবা ফুলের মতো লাল হয়ে মস্তিষ্ক হাতড়ে বাংলা ত্যানার একটা ভদ্রস্থ ইংরেজি নাম খুঁজে নিয়ে জবাব দিলাম, 'অ্যাঁ, ইয়ে মানে, ওটা কিচেন টাওয়েল'। বলেই সিমেন্টের মেঝে খুঁড়ে তাতে সেঁধিয়ে যাব কি না, ভাবছি।

এদিকে হো হো হাসির রোল উঠেছে। কাতিয়া খানিকটা দম নিয়ে বলল, 'বুঝলে প্রফেসর, মাসখানেক ধরে এই কিচেনই সাবরিনার হোম অফিস। সুতরাং হাসলে চলবে না কিন্তু, হা হা হা...।' ততক্ষণে ল্যাপটপ ঘুরিয়ে নিয়েছি। ব্যাকড্রপে এখন কোনো পাঁচ কোনা ত্যানা ঝুলে নেই। আছে কালো হুমদো চেহারার রেফ্রিজারেটর। তা–ও সই। আর জার্মানদের ত্যানা প্যাঁচানো স্বভাব কম থাকায় পেশাদার কথাবার্তায় ডুবে যেতে সময় লাগল না।

ঠিক মোক্ষম সময়ে মিটিং শেষ হলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই 'মাআআ...' বলে হুংকার ছেড়ে এক দস্যু ঢুকে পড়ল। কপট ভয় পাওয়ার বদলে দস্যুর কিম্ভূত পোশাক দেখে হেসেই ফেললাম। তার হাতে কার্ডবোর্ডের ঢাল আর গলায় আমার কালো ওড়নাটা সুপার হিরোর কায়দায় ঝালর বানিয়ে ঝোলানো। কিন্তু পরনে শুধু সবুজ রঙের এক চিমটে জাঙ্গিয়া। এমনতর ডাকাত আগে দেখিনি, যার নিজের মান-ইজ্জতই ডাকাতি হয়ে গেছে। হাসিটা সরিয়ে খুব গম্ভীর স্বরে বললাম, 'তুমি কে গো?' উত্তর এল, সে নাকি একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ব্যাটম্যান আর হাল্ক। সিনেমার পর্দায় হাল্ক নামের অতিনায়ককে কখনো জাঙ্গিয়া পরে উড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি বলে মনে পড়ল না।


সে যাক গে, চাপাচাপিতে পড়ে খানিকক্ষণের জন্য কাজে বিরতি দিতে হলো। কাগজের তলোয়ার বানিয়ে নিয়ে পরের আধা ঘণ্টা ধরে দুই ফুটি হাইব্রিড সুপার হিরোর বনামে চলল এক তুমুল ঝনঝন লড়াই।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টনক নড়ল। আরেকটা মিটিং আছে। ঢাল-তলোয়ার ফেলে একটা যুদ্ধবিরতি দিয়ে আবার ল্যাপটপের বোতাম চাপলাম। একসঙ্গে তিনটা মুখ দেখা গেল। তার ভেতর একজন ক্রিস্টিয়ান। ভীষণ লম্বা, ঢ্যাঙ্গা মতো জার্মান ছেলেটা নিউরো-ফার্মাকোলজি বিভাগে পিএইচডি করছে। কাজটা অ্যালঝেইমারস রোগের ওপর। আমার সঙ্গে তার কোলাবরেশন আছে। বাকি দুজন ক্যারোলিন আর আনাস্টাসিয়া। জাতে একজন ফ্রেঞ্চ, আরেকজন রাশিয়ান। মাস তিনেকের জন্য এই মেয়ে দুটোর ব্যাচেলর থিসিস সুপারভাইজ করতে হবে। নিজের জ্বালায় বাঁচি না, আবার পরের কাজের তদারকি।

তবে সানন্দেই রাজি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামে ঢুকেছি। হ্যাবিলিটেশন এক রকমের ডিগ্রি। থাকলে ভালো, না থাকলে ক্ষতি নেই। অধ্যাপনা পেশায় এলে অবশ্য কাজে দেয়। তাই গবেষণার পাশাপাশি পরীক্ষার হলে ডিউটি দেওয়া, ছোটখাটো সুপারভিশন ইত্যাদির সুযোগ পেলে লুফে নিচ্ছি। বছরখানেক খেটেখুটে হ্যাবিলিটেশন করে হাবিলদার বনে গেলে মন্দ হয় না। আর হতে না পারলেও আফসোস নেই। ভেবে নেব, চেষ্টা তো করেছি।


আলোচনায় তন্ময় আমরা চারজন। ঠিক এমন সময়ে হুড়মুড়িয়ে খানিক আগের সুপারহিরো, 'দ্য জাঙ্গিয়াম্যান' ঢুকে পড়ল। তার সঙ্গে খেলতে হবে। এখন এবং এখনই। ইশারায় মাথা নেড়ে মাফ চাইলাম। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রীতিমতো আস্ফালন আর হম্বিতম্বি চলতে থাকল। সঙ্গে ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ভ্যাক কান্না শুরু হলো। এবার সত্যি বিপদে পড়ে গেলাম। ঘরে ঘরে নারী নির্যাতনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসলে শিশুদের হাতে ঘটে থাকে, এই তথ্য কি কেউ জানে?

ক্রিস্টিয়ান, ক্যারোলিনদের কাছে এক মিনিটের জন্য আলাব্বু নিয়ে নারী নির্যাতনকারী শিশু অপরাধীকে এক টুকরা চকলেট ঘুষ দিয়ে বাগে আনার চেষ্টা চালালাম। লাভের লাভ যা হলো, চকলেটটা টপ করে মুখে পুরে সেই তো ভেউ ভেউ বিলাপে ফিরে গেল। যেই লাউ, সেই কদু। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য হয়ে ক্রিস্টিয়ানদের সঙ্গে শর্টকাটে আলাপ সেরে কাজের সঙ্গে সে বেলার মতো আড়ি দিতে হলো।

আড়ি দিয়ে এবার হাঁড়ি চড়ালাম চুলায়। হাউমাউ কান্নাকাটির আরেকটা কারণ, খিদে। কারণ, বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা দুই ছুঁই ছুঁই। খেয়ালই হয়নি যে দুপুরের খাবারের সময় যায় যায়। সরস্বতীটা আজকে খামচেখুমচে খুব ভালোমতো ধরা গিয়েছিল, লেকিন লক্ষ্মী বিবি তো ছুট গায়া। এমনিটাই হয় এক এক দিন। ওদিকে কালো হুমদো ফ্রিজের পেটও গড়ে মাঠের মতো ফাঁকা।

কী আর করা! চালে-ডালে-সবজিতে একটা গোঁজামিলের খিচুড়ি চাপিয়ে দিলাম। সকালে কল্পনার যে ত্রিশূল হাতে গজগজ করছিলাম, এখন সেটাকেই উল্টে ধরে বাস্তবের খুনতি বানিয়ে প্রবল বেগে খিচুড়ি নাড়তে লাগলাম। আর পুরোটা সময়ে কেউ একজন ঢাল–তলোয়ার হাতে এলোপাতাড়ি শত্রু বিনাশ করতে লাগল। তবে মায়েদের জান বড় শক্ত। সামান্য কাগুজে তলোয়ারেই নাশ হয়ে গেলে জগৎ সংসার চলবে কী করে?

পেট ঠান্ডা তো সব ঠান্ডা কথাটা পুরোপুরি সত্য না। ছররা গুলির শব্দ তুলে লেগোর ব্লক ছুটে আসছে। আবার কেনো মা কাজে বসেছে, তাই এই অভিনব প্রতিবাদ। গা বাঁচিয়ে নির্বিকার একটা রিপোর্ট লিখে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ঠকাশ করে মাথার ঠিক পেছনে একটা আধলা ইটের মতো কী যেন ছুটে এসে লাগলে আত্মহারা হয়ে হুংকার দিলাম, 'অ্যাইই...একদম খেয়ে ফেলব কিন্তু এবার!' বেদম এক ফ্যাঁচ কান্না শুরু হলো এবার। বেচারার দোষ নেই। মিউনিখের কিন্ডারগার্টেন করোনার কারণে ছুটি। ঘরে থাকা প্রতিটা মুহূর্ত শিশুরা সঙ্গ চায়, খেলার সাথি চায়। তার দুঃখটা বুঝে নিয়ে কাজ ফেলে আবারও হার মানলাম। তবে এভাবে আরও কিছুদিন চলতে থাকলে আমাকেও ফ্যাঁচফোঁচ কানতে দেখা যাবে। হোম অফিস না ভোম অফিস! দূর ছাই! রিপোর্ট লেখা রাতের জন্য শিঁকেয় তুলে রেখে লেগো খেলতে বসে গেলাম।

আর কেউ শিশু পালন আর চাকরি নিয়ে এমন টালমাটাল অবস্থায় আছে কি না, জানতে দিন কয়েক আগে ডরোথিকে ই–মেইল দিয়েছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা বিজ্ঞানীদের একটা মাসকাবারি আড্ডা বসে। ডরোথি সেটার আয়োজন করে। বিষয়বস্তু সাধারণত একটা গণ্ডির ভেতর ঘুরপাক খায়। যেমন ছোট বাচ্চাওয়ালা মায়েরা কেন বিজ্ঞানকে সেলাম ঢুকে ঘরের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে। কেন জার্মানিতে নারী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা কমে কমে ডোডো পাখির মতো ভ্যানিশ হওয়ার জোগাড়। তাদের কী কী সাহায্য-সুবিধা দিলে তারা আবার গ্রিক মিথোলজির ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে বিজ্ঞানের জগতে একটা প্রলয় বইয়ে দেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

মুশকিল হচ্ছে, আড্ডার লোকসংখ্যা ভয়াবহ কম। মহিলারা এ দেশে ফিনিক্স পাখি হয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তবুও বাকিরা যারা আসে, তাদের প্রাণশক্তি প্রচুর। আমি আগ্রহভরে এই আড্ডায় যাই। আমি চুপচাপ তাদের আলোচনা শুনি। গোটাখানেক স্যান্ডউইচ আর তিন-চার কাপ কাপাচিনো নামিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে চলে আসি। ফ্রি ফ্রি খানাপিনার যেকোনো আয়োজন খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। একটা লাভ অবশ্য হয়েছে। বেশ কিছু পিএইচডি, পোস্টডক আর জুনিয়র গ্রুপ লিডারদের সঙ্গে হালকা সখ্য গড়ে উঠেছে।

ভাবলাম, করোনার এই ফাপরকালে তাদের সঙ্গে কথা বললে হয়তো মনের খেদ মিটবে কিছুটা। বাচ্চাকাচ্চা চ্যাও ভ্যাও নিয়ে হোম অফিস নামের প্যারার ভেতর তো তারাও আছে। এই গ্রহে আমি একাই এই মাইনকার চিপায় পড়ে নেই নিশ্চয়ই।

তাজ্জব ব্যাপার। দেখা গেল, তারা কেউ কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে, কেউ বাবাদের সঙ্গে ভাগ করে ছানাপোনা পালছে, কেউ এক ঘণ্টা কাজ করছে তো পরের ঘণ্টায় ঘর সামলাচ্ছে ইত্যাদি। মোদ্দা কথা, সবকিছু দারুণ পেশাদারি হাতে সুচারুভাবে চলছে। এই না হলে জার্মান ডিসিপ্লিন আর নিঁখুত যান্ত্রিক প্রোডাক্টিভিটি। তাদের বাচ্চারা নাকি অহেতুক কাঁদেও না। নিপাট ভদ্রলোকের মতো পাশে বসে নিজের মনে খেলে। দেখেশুনে বিরাট লজ্জায় পড়ে গেলাম। সামাল দিতে না পারার অপররাধবোধটা ছোট্ট পিঁপড়া থেকে এত্ত বড় হাতি হয়ে গেল। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, একটা দেশি ছানা পেলে পুষে দেখো পারলে। ও তোমাদের পাঁচটা জার্মান বাচ্চা পালার সমান, হু হু। ব্যর্থ লোকজন অজুহাত বেশি খোঁজে আরকি।

দুই.

সবুজ সাগরে সফেদ ফেনা বুদবুদ তুলছে। কী চমৎকার দৃশ্য। কিন্তু মুহূর্তেই ভুলটা ভাঙল। রান্নাঘরের মেঝেতে ডিটারজেন্টের সবুজ বোতলের পেটে চেপে সমুদ্দুর বানানো হয়েছে। তাতে হুটোপুটির ফলে খানিকটা ফেনা তৈরি হয়েছে। দৃশ্য দেখে অধিক শোকে পাথর হওয়ার জোগাড়। শরৎচন্দ্রের ভাষায়, 'তাহারি মাঝখানে হাতে পায়ে পিচ্ছিল তরল মাখিয়া ভূত হইয়া যে পঞ্চবর্ষীয় বালক দাঁড়াইয়া নিষ্পাপ শিশুতোষ হাসি হাসিতেছে, উহাকে দেখিয়া তাহার মাতার পিত্তি জ্বলিয়া একেবারে খাক হইয়া গেল।' দুই মিনিটের জন্য এক সহকর্মীর সঙ্গে ফোনালাপে ছিলাম পাশের ঘরে। আর ফাঁকতালে এ কী কাণ্ড!


পরিস্থিতির কাছে হেরে যাওয়াটা হেড়ে গলায় ডাক ছেড়ে গান গাওয়ার মতোই সহজ। এই মুহূর্তে তাই করব কি না, ভাবছি। চিন্তায় গাল চুলকে প্রায় ছাল তুলে ফেললাম। তারপর সিদ্ধান্ত হলো, মেজাজ হারালে চলবে না। তাই বিশাল একটা বাজখাঁই হুংকার দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ, ছোট শিশুদের সঙ্গে চেঁচামেচির ফল মারাত্মক। তারা তখন মাকে শত্রু ধরে নিয়ে আরও পাঁচ রকমের অনাসৃষ্টির ফন্দি আঁটে।

চার দেয়ালে বন্দী থাকলে লোকের এমনিতেই কিছুদিন পর পাগল পাগল লাগে। আর আমরা দুই মাস ধরে করোনা–কালে ধামাল সামাল দিতে বসতবাড়ির কয়েদে আছি। চার হাতে–পায়ে বানরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছি না যে এটাই বেশি। শিশুদের তো আরও জ্বালা। তাদের পেটভর্তি এনার্জি। অথচ খরচ করার জায়গা নেই। এই প্রথম বোধ হয় রাগ না করে বেচারার দুঃখটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দ্রুত হাতে ডিটারজেন্টের সবুজ সাগর শুকিয়ে খটখটে করে শুধালাম, 'এক পাক দৌড়ে আসি, চলো।' উত্তরে যেন এক শ ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠল।

তাফসু মিয়া দৌড়াতে পছন্দ করে। এই স্বভাব খুব সম্ভবত সে তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। বাড়ির কাছেই নদী আছে একচিলতে। নাম তার ইজার। নদীর পাড় ঘেঁষে খোলা মাঠে দৌড়ে বেড়ানোর মজাই আলাদা। ল্যাপটপের ঝাঁপি ফেলে চটপট পোশাক পাল্টে নিলাম। তাফসু মিয়াকে দুর্দান্ত লাগছে ট্রাউজারের সঙ্গে ছোট্ট নীল স্পোর্টস টি-শার্টে। মুখে মাস্কের কারণে তাকে আসলেই সুপার হিরোদের মতো দেখাচ্ছে। ওদিকে একই মাস্ক পরে আমাকে সাক্ষাৎ সিঁধেল চোরের মতো লাগছে।

যাহোক, মিউনিখের লকডাউন আস্তে আস্তে ডাউন হয়ে আসছে। দোকানপাট, অফিস-আদালত খুলছে। হাঁটাচলা কি দৌড়ে অবশ্য আগে থেকেই বাধা ছিল না। কাজের চাপে সামান্য ঘুরে আসার ইচ্ছাটাও কাজ করে না। আজকে তাই বহুদিন পর গর্ত থেকে মাথা বের করে সূর্যের ঝিলিকে আনন্দে অন্ধ হওয়ার জোগাড়।

খানিক আগে হোম অফিসের মন্ত্রণায় আর ছোট শিশুর যন্ত্রণায় চোখে শর্ষে ফুল দেখছিলাম। আর এখন অবারিত সবুজে চোখ ধাঁধিয়ে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম। মানুষের উৎপাত থেকে কটা দিন রেহাই পেয়ে প্রকৃতি ইচ্ছেমতো সেজেছে। নন্দন কানন কোন ছাড়। এলোমেলো পা চালিয়ে দৌড়াতে থাকা তাফসু মিয়ার ছোট্ট চোখে বিস্ময় আর ধরে না। সে একবার নদীর পাড়ের হাঁসদের ধাওয়া করে তো, পর মুহূর্তেই পড়ে থাকা কঞ্চি তুলে রাখাল বনে গিয়ে অদৃশ্য ভেড়ার পাল চড়ায়।


সপ্তাহের মাঝের দিন। লোকের আনাগোনা কম। ছেলেটার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছি। চার দেয়াল যেন ক্রমেই চেপে ধরেছিল। হঠাৎ ইট–কাঠের কবজা থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁজরের ফুসফুস যেন বুকভরে শ্বাস নিচ্ছে। অবাক হয়ে দেখলাম, মনেরও একটা ফুসফুস আছে, সে–ও আজকের খোলা হাওয়ায় মরচে ঝেড়ে ঝকঝকে চেহারা নিয়েছে। শিশু পালন আর কাজকর্মের চাপকে আর পাহাড়ের মতো ভারী লাগছে না। ছোটখাটো টিলা মনে হচ্ছে বড়জোর। যেন অনায়াসে তাকে লাফিয়ে ডিঙিয়ে পেরোনো যাবে। এই আনন্দটাই যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল এই কদিন। আজকে রোদের কণায়, শিশুর হাসিতে, উড়ে যাওয়া হাঁসের ডানায় তাকে ফিরে পেয়ে নিজেকে শিমুল তুলার মতো হালকা লাগছে। বেঁচে থাকার কুসুম কুসুম বোধটা আড়মোড়া দিয়ে জেগে হতবিহ্বল করে দিচ্ছে।
তুলার মতোই প্রায় উড়ে উড়ে দুজন ঘরে ফিরলাম। আঙুলের ইশারায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সারা দিনের লন্ডভন্ড ঘর গুছিয়ে, আরেক প্রস্থ হাঁড়ি নেড়ে রেঁধে বেড়ে, ছেলেকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে হদ্দ ক্লান্ত না হয়ে, দারুণ চনমনে মন নিয়ে আবার কাজে বসলাম। মনের অতলে যে বল পেলাম, আকারে সে প্রায় ছোটখাটো একটা ফুটবলের মতোই প্রমাণ সাইজ। এই মনের বল আর কিছুতেই হারাতে দেওয়া যাবে না। মহামারির এই প্রচণ্ড সময়ে বেঁচে থাকাটাই আসল জিতে যাওয়া। সামান্য গেরস্থালি উৎপাতে হেরে ভূত হয়ে গেলে ষোলো আনাই যে জলে গেল।


কী মনে করে এক পলকের জন্য টেবিল থেকে উঠে গেলাম। নিপাট বিছানার ঠিক মাঝখানে ঘুমের রাজ্যে বিভোর ছোট্ট তাফসু মিয়া। শিশুদের গায়ে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সফেদ একটা বিশুদ্ধ ঘ্রাণ থাকে। নাক ডুবিয়ে সেই ঘ্রাণ টেনে নিলাম। এই কটা দিন তাকে শত্রু ঠাউরে কতই না বিরক্ত হয়েছি। কাজকেই ১ নম্বরে রেখেছি। আর তাকে দুইতে। অথচ উল্টোটাই সহজাত, উল্টোটাই প্রাকৃতিক। শিশুরা নক্ষত্রের মতো। তাদের ঘিরেই আসলে ক্যারিয়ার, ঘর-গেরস্থালি নামের গ্রহগুলোর ঘুরে বেড়ানোর নিয়ম। ঠিক করলাম, ছোট শিশুকে কোলে–কাঁখে হাসিমুখে যতটুক এগোনো যায়, তা–ই সই। কালকে থেকে ব্যক্তিগত সৌরজগৎটা তাই ঢেলে সাজাতে হবে নতুন করে।

এতে কোনো হার নেই, বরং পুরোটাই জিত।