করোনার আঘাত ও অলিম্পিকের অনিশ্চিত যাত্রা

এক বছর পিছিয়ে গেছে ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের আয়োজন। জাপানের জন্য ২০২০ সাল শুরু হয়েছিল অনেক সম্ভাবনা আর প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে। জাপানের রাজধানীতে ৫৬ বছর পর আবার অলিম্পিক আসার কথা ছিল এই গ্রীষ্মে। সব রকম প্রস্তুতিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, সেই সঙ্গে বাড়ছিল জাপানের প্রত্যাশা। ৫৬ বছর আগে ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিক জাপানের অর্থনীতিকে যেভাবে সামনে ঠেলে দিয়েছিল, আয়োজকেরা আশা করছিলেন ঠিক ততটা না হলেও অলিম্পিকের কল্যাণে জাপানের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোর মন্থর অবস্থাকে পেছনে ফেলে কিছুটা হলেও গতি ফিরে পাবে। তবে তাঁদের সেই প্রত্যাশা আর স্বপ্ন অনেকটাই ভন্ডুল করে দিয়েছে করোনাভাইরাস।

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় হানা দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ জাপানে উপস্থিত হওয়ার পরও অলিম্পিক আয়োজনের চিন্তাভাবনাকে সামনে রেখে টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিও (আইওসি) শুরুতে অলিম্পিক পিছিয়ে না দেওয়া নিয়ে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের সামনে এদের সবাইকে নতি স্বীকার করে নিতে হয় এবং টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটির সঙ্গে আলোচনার পর আইওসি গেমস এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নতুন সময়সূচি অনুযায়ী ২০২০ টোকিও অলিম্পিক শুরু হবে ২০২১ সালের ২৩ জুলাই। তবে কেমন হবে পিছিয়ে যাওয়া সেই অলিম্পিক?

উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান ও ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের জন্য নির্ধারিত টোকিও নতুন জাতীয় স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত বছরের শেষ দিকে। প্রায় শেষ হওয়ার পথে রয়েছে ক্রীড়াবিদদের থাকার জন্য নির্ধারিত অলিম্পিক ভিলেজ। আরও তৈরি করা হয়েছে নতুন বেশ কয়েকটি ভেন্যু। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে গ্রিসের অলিম্পিয়ায় প্রজ্বলিত হওয়ার পর জাপানে চলে এসেছিল অলিম্পিকের অগ্নিশিখাও। মার্চের শেষ দিকে ফুকুশিমা থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল সারা দেশব্যাপী অলিম্পিক মশাল দৌড়। এর সবকিছুই এখন আপাতত তালাবদ্ধ।

গত মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইওসির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ বলেছেন, ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালে অলিম্পিকের আয়োজন করা না গেলে ২০২০ অলিম্পিকের কথা আমাদের ভুলে যেতে হবে। অর্থাৎ, টোকিওতে অলিম্পিকের আয়োজন তখন আদৌ বসবে না। আইওসির এই কঠোর অবস্থানের পেছনে আছে আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাব–নিকাশ। টোকিও অলিম্পিকের জন্য খরচ হওয়া অর্থের বড় অংশ এসেছে স্বাগতিক শহর টোকিও ও জাপান সরকারের কাছ থেকে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিও প্রচুর অর্থ ইতিমধ্যে খরচ করেছে। আইওসির অর্থ সাধারণত সম্প্রচার অধিকার বিক্রি করার মধ্য দিয়ে উঠে আসে, অন্যদিকে স্বাগতিক শহর টিকিট বিক্রির বড় একটা অংশ পেলেও খরচের পুরোটা এর থেকে উঠে আসে না। তবে তা সত্ত্বেও প্রচার এবং সম্মান জড়িত থাকায় স্বাগতিক শহর কিংবা দেশ অলিম্পিক আয়োজনের পেছনে অর্থ খরচ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তবে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া আগের সব হিসাবকে এখন পাল্টে দিচ্ছে এবং আয়োজক কমিটিকে অলিম্পিকের আয়োজন নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতির মাশুলও কমিটিকে গুনতে হচ্ছে।

২০২০ টোকিও অলিম্পিকের জন্য প্রায় শেষ হয়ে আসা অলিম্পিক ভিলেজ প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর কিছুটা রদবদল করে নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ি হিসেবে বিক্রি করার জন্য আয়োজক কমিটি অনেক আগে থেকেই কয়েকটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। সেই সব কোম্পানি বেশ কিছু ফ্ল্যাট ইতিমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছে, বছর শেষ হওয়ার আগেই ক্রেতাদের কাছে যেগুলো হস্তান্তর করার কথা। পরিবর্তিত সময়সূচিতে এখন তা সম্ভব না হওয়ায় ক্রেতাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হওয়ার বিষয়টি এখানে সামনে চলে আসছে। একই সঙ্গে আলোচনায় আসছে অলিম্পিকের অস্থায়ী ভেন্যু হিসেবে তৈরি স্থাপনাগুলো নিয়ে কী করা হবে সেই বিষয়।

করোনাভাইরাস সব রকম কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়ায় শ্বেতহস্তী হিসেবে পড়ে থাকতে হচ্ছে নতুন জাতীয় স্টেডিয়াম ছাড়াও বড় আকারের আরও কয়েকটি স্থাপনাকে। ওগুলোর মধ্যে কয়েকটি স্থাপনায় অস্থায়ী যেসব দর্শক গ্যালারি ইতিমধ্যে বসানো হয়েছিল, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ এখন সেগুলো খুলে ফেলতে শুরু করেছে। টোকিওর কোতো ওয়ার্ডের আওমি আর্বান স্পোর্টস পার্ক হচ্ছে সে রকম একটি স্থাপনা, স্পোর্টস ক্লাইম্বিং প্রতিযোগিতা যেখানে অনুষ্ঠিত হবে। সীমিত স্থায়ী আসনসংখ্যার বাইরে ইস্পাত ও পাইপ ব্যবহার করে অস্থায়ী দর্শক আসন সেখানে তৈরি করে নেওয়া হয়েছিল। তবে ভূমিকম্প কিংবা সামুদ্রিক ঝড় তাইফুনে এ ধরনের কাঠামোর ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করে আয়োজক কমিটি ইতিমধ্যে তা সরিয়ে নিতে শুরু করেছে।

এদিকে চলতি সপ্তাহের শুরুতে সুইজারল্যান্ডের লুজানে আইওসির নির্বাহী বোর্ডের বৈঠকে আগামী বছরের অলিম্পিক আয়োজনকে সহজ ও দক্ষ করে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কীভাবে সেটা করা হবে তার ব্যাখ্যা দিয়ে আইওসির নির্বাহী পরিচালক ক্রিস্তফ দুবি বলেছেন, তিনটি ভিন্ন দিক থেকে সহজ ও সাদামাটা ধরনের অলিম্পিক আয়োজনের দিকটি বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। তিনটি দিক হলো সেবার মান, গেমস চলাকালে যেসব জিনিসপত্র সাধারণত ক্রীড়াবিদ ও অতিথিদের মধ্যে বিতরণ করা হয় সেগুলোর সংখ্যা এবং ভেন্যু-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও পরিচালনা। তবে বোর্ডের বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে রাখা বক্তব্যে আইওসির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে অলিম্পিক আয়োজনের কাটছাঁটের আওতার মধ্যে ক্রীড়াবিদের সংখ্যা হ্রাসের চিন্তাভাবনা করা হলে সেটা হবে ভুল পদক্ষেপ।

আইওসির নির্বাহী বোর্ডের বৈঠকের পর গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে টোকিও আয়োজক কমিটির সভাপতি ইয়োশিরো মোরি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তোশিরো মুতো’ও ২০২১ সালের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আড়ম্বরপূর্ণ দিকগুলো কাটছাঁট করে প্রতিযোগিতা আরও সহজ করে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে মিলে টোকিওর আয়োজক কমিটি ইতিমধ্যে সহজ করে নেওয়ার জন্য প্রায় ২০০টি দিক চিহ্নিত করে নিয়েছে বলে তাঁরা উল্লেখ করলেও এর বিস্তারিত কোনো বর্ণনা সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা দেননি। আইওসি অবশ্য এর আগে উল্লেখ করেছে যে অলিম্পিকের মশাল দৌড় ২০০টির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

মুতো বলেছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই হবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত করে নেওয়া। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ক্রীড়াবিদদের বাইরে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুক্ত লোকজনের সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি আয়োজকেরা বিবেচনা করে দেখছেন এবং এই সংখ্যা হ্রাসের হিসাবে আইওসির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা সম্ভবত অন্তর্ভুক্ত হবেন।

বিভিন্ন সূত্রের আনুমানিক হিসাবে দেখা যায়, অলিম্পিক পিছিয়ে পড়ার আর্থিক যে মাশুল আয়োজকদের দিতে হবে তার পরিমাণ হচ্ছে ২০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার এবং এর সিংহভাগ বহন করতে হবে জাপানের করদাতাদের। ফলে ব্যয় হ্রাসের দিকটি এখন জাপানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখতে হচ্ছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে বিশাল পরিমাণ অর্থ জাপানকে ইতিমধ্যে খরচ করতে হওয়ায় জাপানের পক্ষে আরও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা সামাল দেওয়া এখন কঠিন। আরও যে একটি প্রশ্ন আয়োজকদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে তা হলো, ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া না গেলে সে রকম অবস্থায় দর্শকদের স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকা নিয়ে কী করা হবে। সন্দেহ নেই দর্শকশূন্য অলিম্পিকের আয়োজন খরচের অর্থ উঠে আসাকে আরও বেশি অসম্ভব করে তুলবে।

দর্শক উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে মোরি বলেছেন, অলিম্পিকে দর্শকের উপস্থিতি হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অগ্রগতির দিকে নজর রেখে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী করা দরকার সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা নেবেন। তবে একই সঙ্গে তিনি নিশ্চিত করে দিয়েছেন যে ২০২১ সালের ২৩ জুলাই অলিম্পিকের উদ্বোধনী তিনি দেখতে চান।

এ কারণেই মোরি হয়তো এতটা জোর দিয়ে পুনর্নির্ধারিত সময়ে অলিম্পিক আয়োজনের কথা বলে থাকবেন যে তাঁর নিশ্চিত জানা আছে, সেই সুযোগ জাপান আবার হারালে ২০২০ অলিম্পিকের টোকিওতে আসা আর হয়ে উঠবে না এবং বিশাল যে অর্থ অলিম্পিকের আয়োজনের পেছনে খরচ করা হয়েছে, তার সবটাই হয়তো তামাদি খরচ হয়ে উঠবে।