এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সামাজিক দূরত্ব নিয়ে প্রশ্ন

সামাজিক দূরত্ব রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকেরা। ছবি: রয়টার্স
সামাজিক দূরত্ব রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকেরা। ছবি: রয়টার্স

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। এবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাদের ‘দুই মিটার’ নিয়ম নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রবীণ বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রভাবশালী একটি গবেষণায় ত্রুটি থাকার কথা বলেছেন। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ও ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব ঠিক করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাজ্যের ২ মিটার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম করে সবকিছু শিথিল করে দেওয়ার বিষয়টি ঠিক হবে না।

সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির সমালোচকেরা বলেন, মানুষকে দুই মিটারের বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে বলাটা অতি সতর্কতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দেন যাতে বলা হয়েছে, দূরত্ব ২ মিটার থেকে ১ মিটারে কমিয়ে আনলেও ঝুঁকি সামান্যই বাড়ে, যা মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞানীরা এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীরা কীভাবে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব নির্ধারণ করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওপর নির্ভর করতে পারছেন না। তাঁরা এর মধ্যে ত্রুটি দেখতে পাচ্ছেন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ অধ্যাপক ডেভিড স্পিগেলহাল্টার বলেছেন, ‘২ মিটার বনাম ১ মিটার সংক্রমণের ঝুঁকির বিশ্লেষণকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। আমি এটি সম্পর্কে ব্যাপক সন্দেহ পোষণ করি।’

ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ অধ্যাপক কেভিন ম্যাককনওয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে এ বিশ্লেষণকে অনুপযুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘২ মিটারের বিপরীতে ১ মিটার ন্যূনতম দূরত্বে সংক্রমণের ঝুঁকি কত বেশি তার পক্ষে যুক্তি ব্যবহার করা উচিত নয়।’

‘ল্যানসেট’ সাময়িকীতে গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এটি নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে গবেষণা নিবন্ধ লেখা, পর্যালোচনা করা ও প্রকাশ করা হচ্ছে দ্রুত, যাতে যথেষ্ট মান বিচার করা হচ্ছে না। এর আগে এ মাসের শুরুতে ‘ল্যানসেট’ ও ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’ তাদের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে ত্রুটি পাওয়ায় তা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২ মিটার দৈহিক দূরত্ব নিয়মটির একটি আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা ঘোষণা দেওয়ার পর এই গবেষণা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু হয়েছে। ৪ জুলাইয়ের মধ্যে এ বিষয়টি পর্যালোচনা করার কথা রয়েছে। ওই সময় যুক্তরাজ্যের পানশালা ও রেস্তোরাঁ আবারও চালু হতে পারে। সম্প্রতি বরিস জনসন এই খাতের ব্যবসায় সহায়তা করতে লকডাউন শিথিল করার জন্য কনজারভেটিভ এমপিদের তীব্র চাপের মধ্যে পড়েছেন।

অন্টারিওর ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে এই প্রতিবেদনে পূর্বে প্রকাশিত গবেষণার তথ্যকে বিভিন্ন দূরত্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনুমান করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এতে মাস্ক ও চোখের সুরক্ষা কীভাবে রোগের বিস্তার রোধে সহায়তা করতে পারে, তা–ও বিবেচনা করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষণে লেখকেরা ২ মিটার থেকে ১ মিটারে যাওয়ার ঝুঁকির আনুপাতিক প্রভাবটি ১ মিটার থেকে শূন্যের দিকে যাওয়ার সমান বলে ধরে নিয়েছেন। স্পিগেলহাল্টার বলেছেন, তাঁরা আনুপাতিক অবস্থা একই হতে বাধ্য ধরে নিয়েছেন।

ম্যাককনওয়ে মনে করেন, গবেষণায় বিভিন্ন দূরত্বে সংক্রমণের ঝুঁকি যেভাবে তুলনা করা হয়েছে তাতে আরও একটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে। এতে বিভিন্ন দূরত্বের তুলনা করার পদ্ধতিটি ২ মিটার ন্যূনতম দূরত্বে যে ঝুঁকিটি ১ মিটার ন্যূনতম দূরত্বের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তা অনুপযুক্ত। এটি সমর্থনযোগ্য নয় বা একে ব্যবহার করা উচিত নয়।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেন কাউলিং বলেছেন, ‘তিনি এ গবেষণাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। কারণ, এটি কেবল দূরত্বের কথা বলেছে, কিন্তু কতক্ষণ থাকলে সংক্রমণ ছড়াবে, সে কথা বলা হয়নি।

ম্যাককনওয়ে মনে করেন, এত তাড়াহুড়ো করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর পর্যালোচনা করেছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে বাদ গেছে। প্রত্যেকে বিশ্বাস করে যে ১ মিটারে সংক্রমণের ঝুঁকি ২ মিটারের চেয়ে বেশি এবং তা কতটা বেশি সেটা আমাদের জানতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা এক মিটার বা তার বেশি দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়। পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এবং তথ্য বিশ্লেষণের ফলাফলে ১ মিটার বা তার বেশি দৈহিক দূরত্বকে সমর্থন করা যায়। এটি বিদ্যমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যাতে মানুষকে শারীরিকভাবে কমপক্ষে ১ মিটার দূরে থাকতে বলা হয়।