সময় নষ্ট করলে সামনে ঘোরতর দুর্দিন

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছে ছয় মাস হতে চলল। এখন পর্যন্ত মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এক অঞ্চলে সংক্রমণের বিস্তার কমলে বাড়ছে অন্য অঞ্চলে। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুততম সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সামনের দিনগুলোতে এই অঞ্চলে আরও ঘোরতর বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা গতকাল রোববার ৯০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৪৭ লাখের বেশি। মারা গেছেন প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার। এই তথ্য করোনা মহামারির সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফোর।

দক্ষিণ এশিয়ায় গতকাল সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সাড়ে সাত লাখ ছাড়ায়। মৃত্যুও ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এর বিপরীতে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যাও কম নয় এই অঞ্চলে। এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি করোনায় সংক্রমিত রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবে এই অঞ্চলে এই মহামারি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে সন্তুষ্ট নন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের আশঙ্কা, জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে পরিস্থিতি অচিরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় করোনায় সংক্রমিত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যায় ভারত শীর্ষে। সংক্রমিত রোগীর সংখ্যায় দেশটি বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ দেশ। দেশটিতে গত শনিবারই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়েছে।

গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা পর্যন্ত মৃত্যু সাড়ে ১৩ হাজার ছুঁই ছুঁই ছিল। এই অঞ্চলে ভারত ছাড়াও রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নেপালেও। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে শনাক্ত রোগী লাখ ছাড়িয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় গত মার্চের শেষ দিকে ভারতের সরকার দেশজুড়ে লকডাউন আরোপ করেছিল। তবে কয়েক দফায় লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর পর তা শিথিল করেছে কর্তৃপক্ষ। এরপরই ভারতে সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটেছে যেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা সংস্থা হার্ভার্ড গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আশিস ঝা বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমি (সংক্রমণের) সংখ্যা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। এটা এমন নয় যে সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে আবার নিজে থেকেই কমতে শুরু করবে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে হস্তক্ষেপ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে একটা দেশের ন্যূনতম ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত হতে হয়। কিন্তু ভারত সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। কারণ, হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে গেলে প্রচুর মানুষের প্রাণ যাবে। এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের জৈবপরিসংখ্যানের অধ্যাপক ভ্রমর মুখার্জি বলেন, ভারতে এখনো সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী গতি শ্লথ হয়নি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি প্রকৃত অর্থেই উদ্বেগজনক।

শুধু ভারত নয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে গত সপ্তাহে রাজধানী কাবুলের গভর্নর ইয়াকুব হায়দারি বলেছিলেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। মানুষ রাতের আঁধারে প্রিয়জনকে দাফন করছে। দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কি লকডাউন শিথিল কিংবা সেভাবে কার্যকর না করার কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার এই অবস্থা হলো? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু লকডাউন নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই রোগী ও সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত, আলাদা করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আইসোলেশন করার কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে পরীক্ষা কার্যক্রমে। অথচ করোনা মহামারির শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে আসছে।

অনেকের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ায় জনঘনত্বের কারণেই করোনা মোকাবিলার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁদের মতে, এই অঞ্চলের দেশগুলোয় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলা অসম্ভব। তা ছাড়া শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতিও রয়েছে।

তবে এর জবাবও এসেছে দক্ষিণ এশিয়ায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যায় শীর্ষে থাকা দেশ ভারত থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ওয়েবসাইটে এক ব্লগ পোস্টে জানানো হয়, ভারতের মহারাষ্ট্রের ধারাবি বস্তি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি। এই বস্তি এতটাই জনাকীর্ণ যে গড়ে প্রতি ৮০ জন বাসিন্দার জন্য একটি করে শৌচাগার সেখানে। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা মোটেই সম্ভব নয় এখানে। এদিকে গত এপ্রিলে এই বস্তিতে সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটে যেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্তৃপক্ষ সেখানে ব্যাপক হারে পরীক্ষা ও আইসোলেশন কার্যক্রম শুরু করে। এর ফলে গত মে মাসের গোড়ার দিকে এই বস্তিতে দৈনিক রোগী শনাক্তের হার তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা মোকাবিলায় ধারাবি বস্তির উদাহরণ অনুসরণ করা যেতে পারে।