করোনার সঙ্গে লড়ো, নয়তো পালাও

শরীরের তাপমাত্রা মাপছেন ব্রাজিলের স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: এএফপি
শরীরের তাপমাত্রা মাপছেন ব্রাজিলের স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: এএফপি

আমাজনের গভীরে বাস করা আদিবাসীদের একটি গ্রাম ক্রুজেইরিনহো। এখন প্রায় ফাঁকা। করোনা মহামারি থেকে রক্ষা পেতে গ্রামটির বেশির ভাগ সদস্য বনের গভীরে পালিয়ে গেছে। ওই গ্রাম থেকে নৌকায় যেতে এক সপ্তাহ সময় লাগে—এমন একটি গ্রাম উমারিয়াকাও। সেখানকার লোকজন ভাইরাস ঠেকাতে ভিন্ন কৌশল বেছে নিয়েছে। গ্রামে ঢোকার পথেই রাস্তার ওপর টাঙিয়ে দিয়েছে হাতে আঁকা একটি চিহ্ন। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘দৃষ্টি আকর্ষণ: আদিবাসী এলাকা। ১৫ দিনের জন্য বন্ধ’। পেরু ও কলম্বিয়া সীমান্তের কাছে উত্তর ব্রাজিলের পাঁচ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে এমন সতর্কতাই চোখে পড়বে।

ব্রাজিলে করোনার সর্বনাশা রূপ দেখে আতঙ্কিত অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে। ইতিমধ্যে সেখানে ৫১ হাজার মানুষ মারা গেছেন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এসব প্রান্তিক আদিবাসী লোকজন। বাইরের দুনিয়া থেকে হানা দেওয়া রোগে তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।

মূল জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এসব মানুষ অতীতে হাম ও ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগেছেন। এখন তাঁদের মধ্যে করোনা ছড়ানো নিয়ে ব্যাপক ভীতি কাজ করছে।

ব্রাজিলে ইতিমধ্যে ৭ হাজার ৭০০ আদিবাসী করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। মারা গেছেন ৩৫০ জন। ব্রাজিলের ইন্ডিজেনাস পিপলস অ্যাসোসিয়েশন (এপিআইবি) সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তারা দেশটির প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোকে এর জন্য দায়ী করছেন। তাঁদের অভিযোগ, ব্রাজিলে নয় লাখ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে রোগের বিস্তার ঠেকাতে বোলসোনারো কিছুই করেননি।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, আদিবাসী লোকজন এখন নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করছেন। উমারিকাও রিজার্ভ এলাকায় টিকুনা সম্প্রদায় তাদের অঞ্চলে বাইরের লোক ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ওই সম্প্রদায় প্রধান সিলদোনেই মেনদেস দ্য সিলভা বলেন, ‘এটা কঠিন সিদ্ধান্ত। তবে এটা প্রয়োজন। এটি এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা থাকে। এ মহামারি দারুণ ক্ষতিকর।’

মুখে কালো রঙের মাস্ক পরা সিলদোনেই বলেন, ‘কলম্বিয়া থেকে আমাদের এখানকার দূরত্ব ১৫ মিনিটের। সেখান থেকে লোকজন এখানে মাছ, ফলমূলসহ বিভিন্ন জিনিস কিনতে আসে। আমাদের নিজেদের আরোপিত কোয়ারেন্টিনের কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ ব্যবস্থায় ভাইরাসের প্রকোপ থামানো যায়নি। ২৪ জন আক্রান্ত ও ২ জন মারা গেছেন।’

ওই এলাকায় ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণে থাকা ওয়েডসন গোসেল পেরেইরা বলেন, কেউ যদি মাস্ক ছাড়া বন্ধ রাস্তার এদিকে আসে, তবে তাকে ফেরত পাঠানো হয় এবং মাস্ক পরতে বলা হয়।’

তবে আদিবাসী–অধ্যুষিত এ অঞ্চলে মাস্ক দুর্লভ। এখানকার অনেকই মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের মতো বিষয়গুলো বোঝে না। এ অঞ্চলে ভাইরাস বিস্তার ঠেকাতে তরুণ সদস্যদের বাড়িতে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এপিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভাইরাসে এলাকাপ্রধান, বয়স্ক ও স্থানীয় চিকিৎসকদের মৃত্যু হচ্ছে। এটি আমাদের সংস্কৃতি, মুখে মুখে চলা আসা ইতিহাস ও প্রাকৃতিক ওষুধের বড় ক্ষতি করতে পারে।

সেখান থেকে আরও দূরের জাভারি নদীর কাছের একটি গ্রাম লকডাউনের বদলে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। সেখানকার বেনে মায়ুরুনা নামের এক বাসিন্দা বলেন, গ্রামে মাত্র পাঁচ ঘর বাসিন্দা অবশিষ্ট আছে। তারা বনে পালাতে চায়নি। বাদবাকি সবাই অন্যের সংস্পর্শে আসার ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেছে।

আমাজন জঙ্গলে শুধু ব্রাজিলের আদিবাসীরা পালিয়েছে, তা–ই নয়, গত এপ্রিলে রেইনফরেস্ট ফাউন্ডেশন নরওয়ের প্রধান ওয়েভিন্দ এগেন বলেন, ‘আমারা শুনেছি, পেরু, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের অনেক আদিবাসী করোনার ভয়ে পালিয়ে গেছে। রেনফরেস্ট অধিবাসীদের এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে।

ব্রাজিলের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সম্প্রতি স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দল ক্রুজেইরিনহোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছে। সেখান থেকে সুখবর হচ্ছে, নতুন কোনো সংক্রমিত রোগী পাওয়া যায়নি।