জাপানে আবার করোনা শনাক্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল

জাপানের ফুটবল মাঠে মাস্ক ও গ্লাভস পরে এক বল বয়। ছবি: রয়টার্স
জাপানের ফুটবল মাঠে মাস্ক ও গ্লাভস পরে এক বল বয়। ছবি: রয়টার্স

জাপান যখন করোনামুক্ত হতে পারা নিয়ে অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিল, সে রকম অবস্থায় ভাইরাসের আরেকটি আঘাত এখন সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় চট করে হারজিত নির্ধারণ করে ফেলা কতটা কঠিন। এপ্রিল মাসে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে একপর্যায়ে দৈনিক হিসাব ২০০-র কাছাকাছি চলে গেলে সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা প্রচার করে। সেই নির্দেশনার আওতায় রেস্তোরাঁ-পানশালা ও খুচরা বিক্রির দোকানপাট বন্ধ রাখার সুপারিশের বাইরে আরও ছিল ভিড়ের জায়গা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়াও নিয়মিতভাবে মাস্ক পরা, বাইরে থেকে ফিরে এসে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নেওয়া এবং মুখ ধোয়ার জন্য নাগরিকদের প্রতি জানানো হয় অনুরোধ। মানুষ সেগুলো কম-বেশি মেনে চলায় করোনার দাপট ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করে এবং দৈনিক শনাক্ত হওয়া সংক্রমণের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। সরকার এতে উদ্দীপ্ত হয়ে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই মে মাসের শেষদিকে জরুরি অবস্থা পুরোপুরি তুলে নেয়। সে রকম অবস্থায় ধীরে হলেও জাপানের রাজধানীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছিল।

তবে এক সপ্তাহ ধরে জাপানে নতুন রোগী চিহ্নিত হওয়ার সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে রাজধানী টোকিওতে নতুন সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে না হলেও যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৫ মে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর থেকে নতুন চিহ্নিত সংক্রমণের হিসাবে পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধি কিছুটা হলেও উদ্বেগে ফেলছে জাপানের স্বাস্থ্য খাতকে। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরের ছয় দিনে নতুন চিহ্নিত সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৭০টির বেশি এবং এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে পুরো সপ্তাহের হিসাব ঊর্ধ্বমুখী পথে যাত্রা করতে দেখা যায়। যেমন দুই সপ্তাহ আগে সপ্তাহব্যাপী শনাক্ত হওয়া নতুন চিহ্নিত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৯১, গত সপ্তাহে তা দাঁড়ায় ৪০৭ জনে এবং চলতি সপ্তাহের হিসাবে ইতিমধ্যে ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে আজ শনিবার জাপানের রাজধানীতে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে ৫৭টি, যে হিসাব হচ্ছে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ।

অন্য হিসাবে দেখা যায়, আজ শনিবার পর্যন্ত চার দিনে টোকিওর দৈনিক চিহ্নিত করোনা সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৫০-এর ওপরে। শুরুতে শুধু টোকিওতে সংক্রমণ সীমিত থাকতে দেখা গেলেও এখন তা আবারও দেশের অন্য কিছু এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল শুক্রবার সারা দেশে চিহ্নিত সংক্রমণের সংখ্যা আবারও ১০০ ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৫৪টি চিহ্নিত হয়েছে টোকিওতে।

করোনাভাইরাসের এ রকম ফিরে আসাকে জাপানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অবশ্য এখনো ভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত হানা হিসেবে দেখছেন না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকে শুক্রবার বলেছেন, এই ঊর্ধ্বমুখী গণনা সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের ইঙ্গিত দেয় না। কারণ হিসেবে তিনি অধিকাংশ সংক্রমণের গতিপথ চিহ্নিত করতে পারার উল্লেখ করেন। বিশেষ করে রাজধানী টোকিওতে অধিকাংশ সংক্রমণের উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে নগরীর কয়েকটি রাত্রিকালীন বিনোদন স্থানকে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা গেছে শিনজুকু ওয়ার্ডের কাবুকি চো মহল্লায়। শিনজুকুর কাবুকি চো মহল্লাটি নানা ধরনের নাইট ক্লাবের জন্য পরিচিত। জরুরি অবস্থা চলতে থাকার সময় সেগুলো বন্ধ রাখা হলেও এখন পুরো এলাকা আবারও কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বেলাতেও দেখা দিচ্ছে শিথিলতা এবং সেই সুযোগে আবারও আঘাত হানছে করোনাভাইরাস।

নগর কর্মকর্তারা মনে করছেন, আগের মতো রাজধানীর অনেক এলাকাজুড়ে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়নি বলে এই অবস্থাকে ভাইরাসের দ্বিতীয় আঘাত হিসেবে দেখা যায় না। বরং সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় মানুষের সতর্ক থাকার ব্যাপারে শিথিলতার কারণে ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে বলে তাঁদের ধারণা। সংক্রমণ মারাত্মক আকার না নেওয়ার আরেকটি যে কারণের উল্লেখ তাঁরা করছেন তা হলো, এবার অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে এর বিস্তার। করোনাভাইরাসের সর্বশেষ এই প্রবাহে যাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বয়স ২০ এবং ৩০ এর কোঠায়, দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যাঁদের বেশি। ফলে নগর প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাইরাস বিস্তৃত হয়ে মারাত্মক আকার নেওয়ার সুযোগ এটা সীমিত করে দিচ্ছে।

তবে তা সত্ত্বেও নাগরিক মনে নতুন করে উদ্বেগ যে দেখা দিচ্ছে না, তা নয়। বিশেষ করে জাপানের অন্যান্য এলাকাগুলোতে আবারও সীমিত আকারে ভাইরাসের চলে আসাকে সেখানকার লোকজন দেখছেন টোকিওর খামখেয়ালিপনার নিদর্শন হিসেবে। মানুষের নিজের জেলার বাইরে না যাওয়ার ওপর মৌখিক যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর ছিল, সরকার সেটা তুলে নেওয়ায় অনেকেই ছুটছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ উপলক্ষে কিংবা পারিবারিক ভ্রমণে। আর এভাবেই নিজেদের অজান্তে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন করোনাভাইরাস। শুক্রবারের ১০৫টি চিহ্নিত সংক্রমণের মধ্যে টোকিওর ৫৪টির বাইরে রাজধানীর লাগোয়া ইবারাকি ও কানাগাওয়া জেলা ছাড়া পশ্চিম জাপানের হিওগো জেলা এবং উত্তরের জেলা হোক্কাইডোতেও নতুন সংক্রমণ খুঁজে পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে আশাব্যঞ্জক দিকটি হলো, সংক্রমণ আবারও ছড়াতে থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যা সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। শুক্রবার যেমন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কারও মৃত্যু হয়নি। তবে সংক্রমণ বিস্তারের গতি এভাবে বাড়তে থাকলে সেই হিসাবেও রদবদল দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞরা।

এদিকে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হলেও অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি আরও কিছুটা বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। পর্যটন খাতের ব্যবসার গুছিয়ে নিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে আরও অনেক সময় লাগবে। ভাইরাসভীতি কেবল জাপানেই নয়, বরং বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মানুষকে ঘরমুখী করে রাখছে। একই সঙ্গে বন্ধ আছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জাপানের বিমান যোগাযোগ। হাতে গোনা কয়েকটি দেশের সঙ্গে নিয়মিত বিমান যোগাযোগ জাপান আবারও শুরু করলেও যাত্রী সেখানে মূলত রয়েছেন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকজন। ফলে বিমান কোম্পানির ব্যবসাও এখন গভীর সংকটের মুখে। আর এই সংকটে যাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে, তারা হলো ভ্রমণ ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ট্রাভেল এজেন্সি।

জাপানের নেতৃস্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সি এইচআইএস ঘোষণা করেছে, দেশের ভেতরে ৮০ থেকে ৯০টি কার্যালয় এ বছরের মধ্যে কোম্পানি বন্ধ করে দেবে। করোনাভাইরাস মহামারির মুখে লোকসানের হিসাব বৃদ্ধি পেতে থাকায় ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ এইচআইএস নিচ্ছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে নতুন গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগও বন্ধ রাখা হবে। এইচআইএস হচ্ছে জাপানের নাগরিকদের জন্য বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করা সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। জাপান সরকার দেশের নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানোয় সব রকম প্যাকেজ ট্যুর এখন কার্যত বন্ধ আছে। কবে আবার তা চালু হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয় ঘোষণা করেছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে হিরোশিমা-নাগাসাকির ওপর আণবিক বোমা হামলার ৭৫তম বার্ষিকীর স্মারক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা মহাসচিব করোনাভাইরাসের কারণে স্থগিত রাখছেন। জাপানের আণবিক বোমা হামলার শিকার এই দুই শহর এর আগে ভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্মারক অনুষ্ঠান সীমিত আকারে আয়োজনের ঘোষণা দিলেও জাতিসংঘ মহাসচিবের আগমন সম্পর্কে আশাবাদী ছিল। বিশেষ করে নাগাসাকিতে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের কোনো মহাসচিব স্মারক অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ায় আন্তোনিও গুতেরেসকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় ছিল শহর কর্তৃপক্ষ। জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তরের এই ঘোষণা নিশ্চিতভাবেই তাদের আশাহত করছে।