মায়ের জন্য বেগুনি কাপ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমার মেয়েটা অসুস্থ। ওর সুচিকিৎসার জন্য দূর দেশে থাকি। মন পড়ে থাকে দেশে, মায়ের কাছে। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে দূরে থাকায় এমনিতেই সারাক্ষণ মন পুড়তে থাকে। তার ওপর করোনার প্রাদুর্ভাব অসহনীয় করে তুলছে জীবনযাত্রা। আগে দুশ্চিন্তা ছিল শুধু নিজেদের মানুষ আর নিকটাত্মীয়দের ঘিরে। সেই দুশ্চিন্তা এখন বিস্তীর্ণ মাত্রায় জেঁকে বসেছে। জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে দেশ ছাপিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের।

করোনা আসার আগে বাড়িতে ফোন করে অসুস্থ মায়ের সঙ্গে কথা বলেই সারা দিনের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে যেতাম। আত্মীয়স্বজন সবার সংবাদ জেনে যেতাম মায়ের কাছ থেকে। আর এখন খবর জানার জন্য মাকে ফোন করার পাশাপাশি আমার প্রধান কাজ ইন্টারনেটে দেশের খবরের কাগজ পড়া। আর কানাডার খবর জানার জন্য নিয়মিত টিভি দেখা। করোনার আপডেট দেখতে দেখতে বুকে কেমন অসহায়ত্ব অনুভব করি।

ছয় মাস আগেই পরিকল্পনা ছিল, ১ জুন অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে যাব। অফিসে ছুটিও নিয়ে রেখেছিলাম। শুরু করেছিলাম কেনাকাটা। মায়ের পছন্দের রং বেগুনি। সব সময় চেষ্টা করি তাঁর জন্য বেগুনি রঙের উপহার কিনতে। মা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জাগতিক কিছু আর তাঁকে টানে না। তারপরও বেগুনি নকশার একটা জগ আর কাপ সেট কিনেছিলাম মায়ের জন্য। জগ আর কাপ—দুটোতেই বেগুনি নকশার ওপর লেখা ‘মম’।

এখন যে কী হবে, ভাবতেই পারি না। মায়ের সঙ্গে আবার দেখা হবে তো? ভাবনা বেশি দূর এগোয় না। বুক মুচড়ে ওঠে। মায়ের মুখ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করি।

বাসা থেকে ১০০ মিটার দূরে ওয়ালমার্ট। ড্রয়িংরুমের জানালা দিয়ে দেখা যায় গাড়ির পার্কিং লট। ঘুম ভাঙার পর আমার প্রথম কাজ জানালা দিয়ে পার্কিং লটে গাড়ির সংখ্যা গোনা। যখন দেখি সেখানে এক–চতুর্থাংশ জুড়ে গাড়ির বহর, তখন ভাবনায় ডুবে যাই। লাইন ধরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, ওরা কি নতুন নতুন ক্রেতা? আমার মতো মাসে একবার বাজার করতে এসেছে? নাকি এর উল্টোটা? করোনার প্রাদুর্ভাবের পর গাড়ি অনেক কমে গিয়েছিল। এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। কারণ, আমাদের প্রভিন্সে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু শুধু একটা প্রভিন্স শঙ্কামুক্ত হলে তো হবে না, পুরো পৃথিবীকে হতে হবে। একা একা কি ভালো থাকা যায়? সবাইকে নিয়ে ভালো থাকাই হবে করোনাকে জয় করা।

বেশির ভাগ মানুষেরই এখানে কাছের আত্মীয়স্বজন নেই। সবাই মানসিকতা মিলিয়ে গড়ে তোলে পারিবারিক বন্ধু। কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে দল বেঁধে দাওয়াত খেয়ে, মাছ ধরে, পার্কে ঘুরে অথবা নদীর ধারে হাওয়া খেয়ে আত্মীয়ের অভাব পূরণ করে। আমাদেরও তেমনই একটা দল আছে। সাস্কাচুয়ান প্রভিন্স সরকার ২০ জুন থেকে বাসার ভেতরে ১৫ জন আর বাইরে ৩০ জন মানুষ জমায়েত করার অনুমোদন দিয়েছে। তবে দুই মিটার দূরত্ব রাখতে হবে। আমাদের দলটি প্রস্তাব দিল নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়ার। কিন্তু আর দশজন মানুষের হিসেবে তো আমার চলে না। ঘরে আমার অসুস্থ মেয়ে। এবার না–ই হলো নদী যাওয়া।

তিন মাস পার হতে চলল সাময়িকভাবে কাজ নেই। স্কুল বন্ধ। সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছে। তবে মানুষকে দিয়েছে বিস্তর সুযোগ–সুবিধা। হাতে অফুরন্ত সময়। সন্তানের সঙ্গে দিনের পর দিন এভাবে ঐকান্তিক সময় কাটানোর কথা জীবনেও ভাবিনি। কিন্তু এত নিশ্চয়তার মধ্যেও কী যে অনিশ্চিত লাগে সামনের দিনগুলো। একদিন হয়তো অফিস–আদালত খুলে যাবে। আমি যাব নিজের কর্মক্ষেত্রে। দেশেও যাব। মায়ের সঙ্গে এবার ছায়ার মতো এঁটে থাকব। প্রিয় বইগুলো পড়ে শোনাব তাঁকে। মায়ের পাশে শুয়ে আমাদের ছয় ভাইবোনের ছোটবেলার গল্প শুনব।