শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে চলে সিডনি

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সৌর প্যানেল। ছবি: রয়টার্স
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সৌর প্যানেল। ছবি: রয়টার্স

এখন শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে চলে সিডনি। বৃহত্তর সিডনির ‘সিটি অব সিডনি’ চলতি বছরে শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে চালিত হওয়ার মাইলফলক অর্জন করেছে। এই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রক্রিয়া অনেক আগে শুরু হলেও গত বছরের শেষ দিকে বিশ্বের কাছে এক নতুন দৃষ্টান্ত রাখে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির জাতীয় বৈদ্যুতিক বাজারের চাহিদার ৫০ শতাংশই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। ‘গ্রিন এনার্জি’ নামে পরিচিত এ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বেশির ভাগেরই জোগান আসে সৌর ও বায়ুশক্তি থেকে। গত বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যাহ্নের আগেই দেশটিতে প্রথমবারের মতো মূল চাহিদার ৫০ শতাংশেরও বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ খাতে দেশটির এই মাইলফলকের নজির মেলে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস (এনএসডব্লিউ) রাজ্যের অন্যতম প্রধান শহর সিডনিতে। এর আগে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান দাবি করেছিলেন, দেশটির সৌরবিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যেই। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর দাবিই নয়, এনএসডব্লিউ বর্তমানে দেশটির সর্ববৃহৎ সৌরশক্তি ব্যবহারকারী এবং উৎপাদনকারী রাজ্য।

২০০৭ সালে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী সিডনিকে কার্বন-নিরপেক্ষ শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১১ সাল নাগাদ সিডনিতে কার্বনের ব্যবহার নেই বলে ঘোষণা দেয় সরকার। এরই ধারা বজায় রেখে বৃহত্তর সিডনির সিটি অব সিডনি চলতি বছরে শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে চালিত হওয়ার মাইলফলকও অর্জন করেছে। অর্থাৎ, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারি যেসব ভবন ও স্থানে বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে, সে সবকিছুই চলে শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের মাধ্যমে। দেশটির নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফ্লো পাওয়ারের সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তির আওতায় এই প্রকল্প চালু রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ এ প্রকল্পের আওতাধীন নয়। বর্তমানে সিটি অব সিডনির মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই পূরণ করে বায়ুকল থেকে আসা বিদ্যুৎ। বাকি বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় ৩টি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সৌর ও বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত এ বিদ্যুতে সরকারের প্রায় ১১৫টি ভবন, যেমন: সরকারি কার্যালয়, গ্রন্থাগার, অডিটোরিয়ামসহ ৭৫টি পার্ক, ৫টি পুল এবং প্রায় ২৩ হাজার রাস্তার বাতি—সবই এখন চলছে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার প্রতিবছর প্রায় তিন কোটি টাকার খরচ বাঁচাবে দেশটির। সে সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা পাবে প্রায় ২০ হাজার টন পোড়া কয়লার কার্বন থেকে।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বৈদ্যুতিক বাজার বা এনইএম দেশটির ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং নর্দান টেরিটরি রাজ্য ছাড়া সমগ্র দেশেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। দেশটির নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সোলার চয়েজের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাঙ্গাস গেমেল নতুন অর্জন নিয়ে বলেন, ‘এটি এমন একটি চমকপ্রদ মাইলফলক, যা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ানরা গর্ববোধ করতে পারে। আর আমরা এও দেখতে পাচ্ছি যে অস্ট্রেলিয়া দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে।’ দেশটির বৈদ্যুতিক চাহিদার ২৫ হাজার মেগাওয়াটের অর্ধেকই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ বলে জানান তিনি। তবে এ ফলাফল আশানুরূপ সময়ের চেয়েও আগে অর্জিত বলেও মন্তব্য করেন গেমেল। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার ভালো আবহাওয়া ভালো ফলাফল এনে দিতে সহায়ক হয়েছে। শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ ও পরিষ্কার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের মিলিত আবহাওয়া বিদ্যুতের বাড়তি জোগান দিচ্ছে।

অন্যদিকে, বাণিজ্যিক বিশ্লেষক গিলেস পার্কিনসন বলেন, ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মাইলফলক অর্জনের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরা তাদের ক্ষমতার চেয়েও কম বিদ্যুৎ প্রদান করছিল। শিগগিরই শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ দ্বারা অস্ট্রেলিয়ার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তবে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে জানান গেমেল ও পার্কিনসন। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদনও বৃদ্ধি করতে বড় বড় ব্যাটারি এবং পাম্পড হায়ড্রো-পাওয়ার ব্যবহার বাড়ানোর প্রয়োজন বেশি বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। এ ছাড়া সরকারের যথাযথ দিকনির্দেশনার আরও উন্নয়ন হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে বলেও মনে করেন বাজার বিশ্লেষকেরা।

ফলে, অনেক প্রকল্পের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাটারি স্থাপন করেছে দেশটির দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার জেমসটাউনে। ১০০ মেগাওয়াটের এ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একই সঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার বাড়িতে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। এই ব্যাটারিকে বর্তমানে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানিব্যবস্থায় যুক্ত করা হয়েছে। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে বিদ্যুতের মূল গ্রিডে।

অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের শীর্ষ কয়লা রপ্তানিকারক দেশ হয়েও তারা কয়লা ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বেশি করে। অস্ট্রেলিয়া কয়লা উৎপাদন করলেও নিজের দেশের জন্য কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না। সোলার এবং উইন্ডমিল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারেই বিনিয়োগ করছে বেশি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা বিদ্যুৎ পাওয়ার তিনটি উপায় হচ্ছে—সূর্য, বায়ু ও পানি। যে দেশে পর্যাপ্ত সূর্যালোক রয়েছে, সেই দেশ সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

গত বছর জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ সংবাদপত্র সিডনি মর্নিং হেরাল্ড বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ‘নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অস্ট্রেলিয়ার কয়লা চায় বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করতে আগ্রহী। দেশটির কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আগামী পাঁচ বছরে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ৪ কোটি ৫ লাখ টন কয়লা আমদানি করতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবছর প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের কয়লা বাংলাদেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। তবে প্রতিবেদনটিতে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বাংলাদেশের জলবায়ুকে প্রভাবিত করবে বলে উল্লেখ করা হয়। কয়লার ব্যবহারে বৈশ্বিক উষ্ণতার যে ক্ষতিকর দিক রয়েছে, তার অন্যতম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। বিশ্বের জ্বালানি খাতের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ কয়লা রপ্তানি করে অস্ট্রেলিয়া। গত বছর দেশটি প্রায় দুই কোটি টন তাপ কয়লা রপ্তানি করেছে। চলতি বছরে অস্ট্রেলিয়া কয়লা রপ্তানি করে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার আয় করে।