এখানে অন্য এক বসন্তের এক দিন

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

শীতের শেষে বসন্ত এসেছে। এসেছে আমাদের শহরেও—ন্যাশভিলে—পাড়ায় পড়ায় সবার আঙিনায়। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, বনলতায় কুঁড়ি এসেছে, কচি পাতা হালকা থেকে গাঢ় সবুজ রং ধরেছে। উদাসী বাতাসে গাছের বড় বড় পাতা পতপত করে নড়ে—সবুজ পতাকার মতন। পাখি ডাকে সারাক্ষণ, যেন উৎসবে মেতেছে তারা! কিচিরমিচির আওয়াজ শুনি দিনে, ঘুমভাঙা রাতেও—দূর ও কাছ থেকে ভেসে আসে কানে, মধুর মধুর কাকলির তান। মৌমাছি ওড়াউড়ি করে, ফুলে ফুলে বসে। এর মাঝে থেকে থেকে বৃষ্টিও হয়—দিনে ও রাতে। এখানে বসন্ত এমনি আসে, এভাবেই আজকাল। এবারও হয়েছে তা–ই, ‘করোনা’র ভয়ে থেমে থাকেনি সে, এসেছে সঠিক সময়ে। তাই দেখি আজ সবই সুন্দর, সবই স্বাভাবিক! তবু যেন কিছু নেই, অথবা কিছু একটা হয়ে গেছে! তাই বুঝি ভয়, সবার মাঝে ভয়, প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে এসে জেঁকে বসেছে—এইবার এই বসন্তে, নদীর ধারের এই লোকালয়ে! যেখানে আমাদের বাস সেখান থেকে বাইরে মানুষের যাওয়া-আসা কম, আনাগোনা নেই বললেই চলে। তবু জীবন থেমে নেই—ডাকপিয়ন আসে রোজ রোজ—চিঠি বিলি করে যায় ঘরে ঘরে, ইউপিএস-ফেডএক্স, তারাও আসে। নির্দিষ্ট দিনে ময়লার গাড়ি আসে ভোরে; জঞ্জাল তুলে নেয়, হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে যায়। সপ্তাহ শেষে মেশিনে ঘাস-কাটা চলে ঘরের সামনে ও পেছনে। তবে এই জনপদের মানুষগুলো যে হোঁচট খেয়েছে, থমকে গেছে, এ কথাও মানতে হয়!

এ রকমই এক দিন আজ—শুক্রবার, রোদ–ঝলমল সোনালি দিনের সওগাত নিয়ে অন্ধকার থেকে জেগে উঠেছে নতুন এক সকাল। আমার পড়ার টেবিল জানালার সাথে—পুবদিকে মুখ করে বসি। সারা দিন ঘরে বসে আপিসের কাজ করি। ফাঁকে ফাঁকে কাচের জানালা দিয়ে জগৎটাকেও দেখি। দেখি নীল আসমানে লাল সুরুজ টগবগ করে জ্বলে, কিন্তু জানালাতে-পোড়াতে পারে না ওই দুষ্টু ‘করোনা’কে। তাই তো দেখি, কিছুটা হলেও, ‘করোনা’ এখানে জীবনটাকে বদলে দিয়েছে, শ্লথ করেছে মানবের গতি, ম্লান করেছে পরিবেশের সৌন্দর্যকে। আগের সেই কোলাহল নেই, নেই সেই আনন্দ! বিকেলবেলা এখন আর শিশুরা হইচই করে না, বল ছোড়াছুড়ি খেলে না। এসব দেখি চোখ ফেলে বন্ধ জানালা দিয়ে—আমি তো অন্ধ নই, কৃতজ্ঞ তাই তোমার কাছে, হে আল্লাহ!

প্রতিবেশী ‘মার্ক-ক্যাথি’র তিনটি মেয়ে—পিঠাপিঠি। আগে মা-বাবার সঙ্গে বের হলে শুধু দৌড়াদৌড়ি করত, এখন কেবল কোলেপিঠে চড়ে, নামে না মাটিতে ভয়ে, কী জানি, হয়তো বা ‘করোনা’র ভয়! এই প্রতিবেশী এ সময় তাঁর সবজিবাগানে আগাছা বাছতেন, পানি ছিটাতেন, এ বছর তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই, মাটি খোঁড়েননি, চারাও লাগাননি একটিও। আরেক প্রতিবেশিনী-নাম জানি না। বের হয়েছেন নিজের হাত-পা প্রসারণের জন্য নয়, বরং তাঁর প্রিয় সঙ্গী কুকুরটাকে হাঁটাতে। এ দেশে কুকুর হাঁটানোর একটি সংস্কৃতি আছে, অর্থ আছে, জানেন নিশ্চয়ই। দড়ি ধরে ধরে তিনি ঘুরেফিরে আসেন আমাদের খোলা বাগানে—সবুজ ঘাসের মাঝে কাজটা সারিয়ে নিয়ে যান চুপিচুপি, গোপনে, নিরিবিলি, যেন আমি দেখতে পাইনি। আমি দেখেও না দেখার ভান করি, তাঁর চোখের সম্মানে।

তুচ্ছ বিষয় ছেড়ে একা একা ভাবি, ‘করোনা’র কথা ভাবি। এ কেমন কথা, এত ক্ষুদ্র, এত তুচ্ছ, অদৃশ্য এক শত্রু দুনিয়ার সব রাজা-মহারাজাদের কাবু করে ফেলল, এত সহজে! কেউ বলেন, জগতে পাপ এত বেড়েছে, তাই ‘করোনা’ এসেছে, কড়া নাড়ছে পাপী-তাপী সবার দুয়ারে দুয়ারে। কেউ বলেন, তিন পরাশক্তি একযোগে মিলে না কি কমাতে চায় পৃথিবীর জনশক্তি। কেন, কোন কুমতলবে, এতে কার লাভ, কীভাবে? অবুঝ আমি, বুঝি না কিছুই! কেউ বলেন, এবার যদি বেঁচে যাই, ভালো হয়ে যাব, মানুষের মতো মানুষ হব। কেউ বলেন, দূর ছাই, এই তো সুযোগ-দু’পয়সা কামাই করে যাই, আগামী দিনের আশায়। কেউ বলেন, ঘরে থাকি নিরাপদে নিরিবিলি, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে....’। কেউ বলেন, কাজে যাই, নয় তো অনাহারে মরব। ঘরে-বসা বেশুমার ওই বেকার মানুষগুলোকে খাওয়াবে কে? আমি বলি, যাঁরা সারা বছর মানুষের রোজগারে ভাগ বসান, কর আদায় করেন, যাঁরা ব্যবসার নামে নিরাপদে কাঁড়ি কাঁড়ি মুনাফা তুলে নেন ঘরে, এই দুর্দিনে তাঁরা এঁদের দায়িত্ব নেবেন না কেন? কোথায় সমাজ, কেন এই ক্ষমতাবানদের ওপর চাপ দিতে পারে না? ‘করোনা’ মানুষকে ভয় দেখাতে পারে, মেরেও ফেলতে পারে; রাজা-প্রজা নির্বিশেষে। অন্যখানে সে আরও সফল, মারাত্মকভাবে সফল! সে দেশবাসীকে এক হতে দেয়নি, এখনো সবাই যার যার সুবিধামতো কথা বলছেন, বিভেদ ভোলেননি একটুও। রাজনীতিজীবীদের খিস্তিখেউড় বন্ধ হয়নি, সরকার ও বিরোধীরা ‘করোনা’র চেয়ে বেশি ভয় পান এক দল আরেক দলকে। দেশে দেশে এই একই হাল! কে জানে, এটা হয়তো বা ‘করোনা’-রই কূটচাল। ‘করোনা’ এসে হেসে হেসে বলে, মানুষ নামের প্রাণী, তোমরা কি বাঁচার যোগ্য? এমন বিপদের দিনেও এক সুরে কথা বলতে পারো না, একভাবে ভাবতে পারো না, এক হতে পারো না? তোমরা আজব জীব বটে!

এসব কী আবোলতাবোল ভাবছি? সুনসান নিস্তব্ধ বিকেলে হঠাৎ শুনি, দূর থেকে ভেসে আসছে করুণ সুর, কারা যেন ব্যান্ড বাজাচ্ছে। আমার জানামতে এ পাড়ায় এমন গানের মানুষ তো কেউ নেই? গিন্নিকে ডেকে বলি, ওই শোন, কে বা কারা বাজাচ্ছে শোকের বাজনা। তিনি কান খাড়া করে শোনেন, অবাক বিস্ময়ে বলেন, বাহ, ভালোই তো! কোথায় এর উৎসস্থল? আমি একটু যাই, দেখে আসি। তিনি আপত্তি করেন, ‘খুলো না দুয়ার, যেও না বাইরে’। শুনিনি স্ত্রীর কথা, দু’কদম এগিয়ে যাই, গিয়ে দেখেই এলাম-একটু দূরে, এক প্রতিবেশী ঘরের পেছনে সবুজ চত্বরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে করুণ সুর তুলছেন, ব্যান্ড বাজাচ্ছেন। বিকেলে বসন্তের হাওয়া সে সুর পৌঁছে দিচ্ছে আশপাশ সবার ঘরে ঘরে! বুঝলাম না, করুণ সুরে তাঁরা কী ‘করোনা’কে ঘুম পাড়াচ্ছেন, নাকি বাজনা বাজিয়ে আপন মনের ভয় দূর করছেন! কেন, কীভাবে, অবুঝ আমি, তাও জানি না!


*লেখক: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর-জার্নাল অব ডেভেলপিং অ্যারিয়াজ