করোনার নতুন ঢেউ নিয়ে বিভ্রান্তিতে জাপান

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

জাপানে করোনাভাইরাস আবার ফিরে আসছে। ফিরে আসছে আগের চেয়ে আরও বেশি মারমুখী চেহারা নিয়ে। সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার সাম্প্রতিক দৈনিক হিসাব পরিষ্কারভাবে এ কথা বললেও দ্বিতীয় এই আঘাত সামাল দিতে হলে কী করা দরকার, সেই পরিষ্কার সিদ্ধান্তে এখনো উপনীত হতে পারছেন না জাপানের নীতিনির্ধারকেরা। এর মূল কারণ হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য আর অর্থনীতির মধ্যে মোটা দাগের কোন বিভাজন টেনে দেওয়া যায়, তা নিয়ে সরকারি মহলের সিদ্ধান্তহীনতা।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাপানে ৬০০টির বেশি নতুন সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার খবর দেওয়া হয়েছে। এই ছয় শতাধিক সংক্রমণের মধ্যে ২৮৬টি হচ্ছে রাজধানী টোকিওতে। উভয় সংখ্যা হচ্ছে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার দৈনিক হিসাবে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর এক দিন পর আজ শুক্রবার টোকিওর নতুন সেই রেকর্ড ভেঙে যায় ২৯৩টি সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। টোকিওতে এভাবে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যাগত রেকর্ডের ভাঙাগড়া লক্ষ করা যাচ্ছে।
পিছিয়ে নেই জাপানের অন্যান্য জনবহুল শহর এবং অঞ্চলও। টোকিওর পার্শ্ববর্তী তিনটি জেলা—কানাগাওয়া, সাইতামা ও চিবাতেও সংক্রমণ আবার বেড়ে চলা নিশ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় সংক্রমণমুক্ত হতে থাকার পথে যাত্রা করা ওসাকাতেও আবার ফিরে আসছে করোনাভাইরাস। গতকাল বৃহস্পতিবার ওসাকায় নতুন ৬৬টি সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। হিওগো, কিওতো ও আইচি জেলাতেও বিগত কয়েক দিনে নতুন সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এ রকম হিসাব-নিকাশ আভাস দিচ্ছে যে জাপানের বড় আকারের নগরকেন্দ্রগুলো এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন এই আঘাতের ক্লাস্টার বা গুচ্ছে পরিণত হচ্ছে। কয়েকটি জেলা অবশ্য এ জন্য পরোক্ষে টোকিওকে দায়ী করছে। তারা বলছে, নতুন চিহ্নিত সংক্রমণের অনেকটিই টোকিওর সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, টোকিও থেকে ফিরে আসা লোকজন সংক্রমণ অন্যত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এদিকে অর্থনীতির থমকে দাঁড়ানো জাপানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর কালো মেঘের আনাগোনা ছড়িয়ে দিতে থাকায় এই দিকও সরকারকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। সবকিছু মিলিয়ে ইতিমধ্যে দোরগোড়ায় উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় আঘাত সামাল দিতে হলে কী করা দরকার, তা নিয়ে এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না জাপানের প্রশাসন।
প্রথম পর্যায়ের আঘাত স্তিমিত হয়ে আসার মুখে জাপান সরকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে জারি করা জরুরি অবস্থা নির্ধারিত সময়ের আগেই তুলে নিয়েছিল। বিশেষ করে অর্থনীতির নাজুক অবস্থা আর বেশি দিন চলতে থাকলে এর ক্ষতিকর প্রভাব যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে পারে, সেই ভাবনা সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করেছিল। জরুরি অবস্থা চলাকালে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ-পানশালাসহ বিনোদনের জায়গাগুলো বন্ধ থাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রচুর মানুষ চাকরি হারায় এবং অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হতে শুরু করে। অন্যদিকে বড় আকারের উৎপাদন খাতও ক্ষতি এড়িয়ে যেতে পারেনি। মূলত ব্যবসায়ী মহলের চাপের মুখে সরকার জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে নেওয়ার কঠোর নানা রকম পদক্ষেপ ক্রমান্বয়ে শিথিল করে নেয়।
শুধু তা–ই নয়, করোনাভাইরাসের হামলায় কার্যত পঙ্গু হয়ে যাওয়া জাপানের একসময়ের শক্তিশালী পর্যটন খাতকে অন্ধকার থেকে বের করে নিয়ে আসতেও নানা রকম প্রণোদনার ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় আঘাতে এখন প্রতিনিয়ত সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ায় এবং দৈনিক হিসাবের রেকর্ড ভেঙে চলায়, নিয়ন্ত্রণ শিথিলের এসব উদ্যোগ নিয়ে জাপান সরকারকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এ কারণেই সরকার চাপের মুখে দেশের ভেতরে ভ্রমণের জন্য প্রণোদনা ও ভর্তুকি দেওয়ার পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসে।
টোকিওর চিহ্নিত নতুন সংক্রমণ মূলত রাতের বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে সীমিত থাকায় টোকিওর মেট্রোপলিটন সরকার এখন রাজধানীর বিনোদনের এলাকাগুলোকে রেড জোন ঘোষণা করে প্রয়োজন ছাড়া সেই সব এলাকায় না যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে জনগণের প্রতি। অন্যদিকে এ রকম নির্দেশিকা জারির ফলে ক্ষতির মুখে পড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দেওয়ার একটি ব্যবস্থাও স্থানীয় সরকার চালু করেছে। তবে এদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশ সরকার এখনো দেয়নি।
টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকে অবশ্য বলছেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ কারণেই ইতিবাচক শনাক্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। তবে তা সত্ত্বেও নগর প্রশাসন চার ধাপের সতর্কতার মাত্রা সর্বোচ্চে উন্নীত করে দেয়। চলতি মাসে এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশ হচ্ছে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সের। আর এ কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা জাপানে যথেষ্ট কম মাত্রায় বিরাজমান আছে। গত কয়েক সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কারও মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের ভাইরাস খুব বেশি কাবু করতে পারেনি। তবে বৃদ্ধদের সংস্পর্শে এলে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রযেছে। তাই এদের প্রতি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এদিকে জাপানের ওকিনাওয়া জেলার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে জাপানের দক্ষিণের এই দ্বীপ জেলায় উদ্বেগ বাড়ছে। মার্কিন মেরিন বাহিনীর ফুতেনমা বিমান স্টেশনে গত কয়েক দিনে ৭৩টি করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া ক্যাম্প হানসেনে আরও ৫৮টি এবং কাদেনা বিমানঘাঁটিতে ৫টি সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া সম্পর্কে জানা গেছে। জেলা প্রশাসন বলছে, সব মিলিয়ে শনাক্ত হওয়া সংক্রমণের সংখ্যা হচ্ছে ১৫০–এর মতো। সংক্রমণ দ্বীপের স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে জেলা সরকার উদ্বিগ্ন। ওকিনাওয়ার গভর্নর ড্যানি তামাকি মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সংস্পর্শে আসা লোকজনের শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখার বিভিন্ন পদক্ষেপ ওকিনাওয়ার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে নেওয়া হয়েছে কি না, স্থানীয় সরকারকে তা জানাতে বলা হয়েছে।