এক বছরে কাশ্মীর থেকে কী পেল মোদি সরকার?

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য। ছবিটি গত সেপ্টেম্বরে তোলা। ছবি: রয়টার্স
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য। ছবিটি গত সেপ্টেম্বরে তোলা। ছবি: রয়টার্স

৫ আগস্ট, ২০১৯। ঠিক এক বছর আগের কথা। সেদিন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ সব সুবিধা বাতিল করে দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার। দেওয়া হয়েছিল নতুন কাশ্মীর গঠনের আশাবাদ। বলা হয়েছিল, নতুন কাশ্মীরে থাকবে না সহিংসতা, উন্নতিতে শীর্ষে উঠবে উপত্যকা অঞ্চলটি। কিন্তু, এক বছর পর তার কতটুকু পূরণ হয়েছে?

হ্যাঁ, একটি বিষয়ে সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে। কারাগারগুলো আটক ব্যক্তিতে উপচে পড়েছে। অনেক কাশ্মীরি জানেনই না, তাদের স্রেফ ‘উবে যাওয়া’ আত্মীয়স্বজন আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত বছরের নভেম্বরে সরকার পার্লামেন্টে একটি হিসাব দিয়েছিল। তাতে প্রকাশ, ওই বছরের ৪ আগস্ট থেকে প্রায় ৫ হাজার ১৬১ জন কাশ্মীরিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর গ্রেপ্তার না দেখানো আটকের কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। পাবলিক সেফটি অ্যাক্টের (পিএসএ) আওতায় কতজনকে আটক করা হয়েছে এবং কতজন এখনো পর্যন্ত কারাগারে আটক আছে—তার সঠিক হিসাব কেউই দিতে পারে না। বিবিসি কাশ্মীরের পুলিশ বিভাগের প্রধান বিজয় কুমারের কাছে এ বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেছেন, এত ‘স্পর্শকাতর তথ্য’ জানানো সম্ভব নয়।

শ্রীনগরভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী পারভেজ ইমরোজ বিবিসিকে বলেন, এই আটক ও গ্রেপ্তারের মূল উদ্দেশ্য ভয় সৃষ্টি করা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এই কাজে সরকার সফল। কাশ্মীরিদের মুখ বন্ধ রাখতে এমন ধরপাকড় ভালো কাজে দিয়েছে। সরকার চেয়েছিল, সাধারণ কাশ্মীরিরা যেন নতুন আইনের বিরোধিতায় ঘর থেকে বের না হয়। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।

শ্রীনগরে কারফিউ চলাকালে মোটরসাইকেলের এক চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন পুলিশ সদস্যরা। ছবিটি ৪ আগস্ট তোলা। ছবি: এএফপি
শ্রীনগরে কারফিউ চলাকালে মোটরসাইকেলের এক চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন পুলিশ সদস্যরা। ছবিটি ৪ আগস্ট তোলা। ছবি: এএফপি

গত বছরের আগস্টে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল করে দেয় ভারতের বিজেপি সরকার। নিন্দুকদের দাবি, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরে জনমিতিসংক্রান্ত পরিবর্তন আনতেই এই কাজ করে বিজেপি। মোদি নিজে বলেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কারণ তাঁর মতে, জম্মু-কাশ্মীরের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন ভারতবিরোধী সহিংসতা সৃষ্টির প্রধান কারণ।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরপরই কাশ্মীরে প্রথম ভাঙন দেখা দিয়েছিল। পুরো অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় ভারত। ভারত ভুক্তির শর্ত হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরকে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। সেই হিসেবেই ওই রাজ্যের ছিল আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা। এই অঞ্চলে যাতে জনমিতি-সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন না হতে পারে, সেই জন্যই কাশ্মীরের অনাবাসিক ভারতীয়রা সেখানে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। তবে নতুন আইনে জম্মু-কাশ্মীরের সব বিশেষ সুযোগ-সুবিধা রদ করে দেয় মোদি সরকার। একই সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এর রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চল এখন সরাসরি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত হয়েছে।

আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশেষ মর্যাদা রদের পরের ছয় মাস জম্মু-কাশ্মীর ছিল কঠোর নিরাপত্তামূলক লকডাউনের আওতায়। ইন্টারনেট সুবিধা প্রায় ছিল না বললেই চলে। ল্যান্ডফোন ও মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। হাজারো রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়। কিছু রাজনীতিবিদকে অবশ্য মুক্তিও দেওয়া হয়। তবে মুক্তি পেলেও বিশেষ সুবিধা রদ হওয়া নিয়ে তাঁরা ‘স্পিকটি নট’। বিজেপি সরকার যদি এমন উন্নয়ন ও গণতন্ত্রই চেয়ে থাকে, তবে তা হয়েছে বটে! কোনো দ্বিমত নেই, সব ‘সহমত’।

শ্রীনগরে নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মী। ছবিটি ১ আগস্ট তোলা। ছবি: এএফপি
শ্রীনগরে নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মী। ছবিটি ১ আগস্ট তোলা। ছবি: এএফপি

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিজেপির মুখপাত্র অশোক কাউল অবশ্য ভিন্নমত দমন ও ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল করা হয়েছে কাশ্মীরে উন্নতি ও প্রগতি আনার জন্য।

বিশেষ সুবিধা রদের এক বছর পূর্তির দিনে কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে দা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটি ছবির গল্প প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা এক কাশ্মীরকে। রাস্তায় রাস্তায় ছিল কড়া নিরাপত্তা, ছিল ড্রোন থেকে শুরু করে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। শ্রীনগরের রাস্তায় চোখে পড়েছে সেনাযানও।

কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা রদের পক্ষে বিজেপি সরকারের একটি প্রধান যুক্তি ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সহিংসতা দমন। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল ডট ইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সহিংসতার পরিমাণ অন্যান্য বছরের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ২৬ জন্য সদস্য এই সময়ে নিহত হয়েছেন। উল্টো দিকে কথিত ‘জঙ্গি’ মারা গেছেন ১১৮ জন। স্থানীয় পুলিশের অবশ্য দাবি, দক্ষিণ কাশ্মীরের ‘জঙ্গি’দের পুরোপুরি মুছে ফেলা গেছে। কিন্তু হতাহতের সংখ্যা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীরে রক্ত ঝরেছে প্রচুর।

এই এক বছরে তবে ‘নয়া কাশ্মীর’ থেকে নতুন কী পাওয়া গেল? ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট যেমন পুরো কাশ্মীরকে কারফিউতে মুড়ে রাখতে হয়েছিল, এবারও তাই। তফাত কেবল সালে। এই উনিশ থেকে বিশ আরকি!