কাশ্মীর নিয়ে সক্রিয় চীন ও পাকিস্তান

ভারত শাসিত কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের সুনশান প্রধান সড়ক। গত ৫ আগস্ট তোলা ছবি। দিনটি ছিল কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা হারানোর প্রথম বার্ষিকী। ছবি: রয়টার্স
ভারত শাসিত কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের সুনশান প্রধান সড়ক। গত ৫ আগস্ট তোলা ছবি। দিনটি ছিল কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা হারানোর প্রথম বার্ষিকী। ছবি: রয়টার্স

জম্মু-কাশ্মীরের দ্বিখণ্ডিত হওয়া ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে চীন ও পাকিস্তানের যৌথ আক্রমণের মোকাবিলায় নামতে হলো ভারতকে। গতকাল বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলতে মরিয়া চীন আরও একবার ব্যর্থ হলেও পাকিস্তানের দাবি, গত এক বছরে এই নিয়ে তিন বার কাশ্মীর প্রসঙ্গ জাতিসংঘে উত্থাপিত হলো। এটা পাকিস্তানের ‘সাফল্য’।

চীন ও পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টাকে ‘ব্যর্থ’ জানিয়ে আজ বৃহস্পতিবার ভারত বলেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে বারবার নিরাপত্তা পরিষদে তোলার ব্যাপারে এই ব্যর্থতা নতুন কিছু নয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই মন্তব্য করে জানায়, চীন এর আগেও দুবার এই চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এবার তারা অন্তত ঠিক করুক, ভবিষ্যতে এই প্রয়াস আর চালাবে কিনা।

গতকাল বুধবার ছিল ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের প্রথম বর্ষপূর্তি। ভারতীয় সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে ওই দিনেই চীন নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপনে সচেষ্ট হয়। নিরাপত্তা পরিষদের বাকি চার স্থায়ী সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার আপত্তিতে উদ্যোগটি মাঠে মারা যায়। এর পরেই জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি টুইট করে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রায় সব সদস্যই মনে করে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ ও দ্বিপক্ষীয় বিষয়। অতএব তা আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না। পাকিস্তানের আরও এক প্রচেষ্টার অপমৃত্যু ঘটল।

জম্মু-কাশ্মীরের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দিনেই ভারতের অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। ফলে ৫ আগস্ট ভারতীয় গণমাধ্যমে মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল রাম মন্দিরের ভূমি পূজা। পাকিস্তান ও চীন ওই অবসরে কাশ্মীরের আন্তর্জাতিকীকরণে সচেষ্ট হয়। এর আগের দিন মঙ্গলবারেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ ও গুজরাটের কিছু অংশসহ পাকিস্তানের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেন। ইমরানের মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদনও করা হয়। ভারত ওই মানচিত্রকে ‘হাস্যকর’ বলে বর্ণনা করলেও পাকিস্তান তাতে দমেনি। পরের দিন বুধবার ইমরান খান চলে যান পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফফরবাদে। সেখানে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে এক ভাষণে তিনি বলেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত চারটি অনুমানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সেগুলোর প্রতিটিই ব্যর্থ। ভারতের পক্ষে এটা ‘কৌশলগত বিপর্যয়’।

অনুমানগুলো কী ছিল সেই ব্যাখ্যা করে ইমরান বলেন, প্রথমত ভাবা হয়েছিল এতে হিন্দু ভোট ব্যাংক মজবুত হবে। দ্বিতীয়ত, ওরা ভেবেছিল পাকিস্তান বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী বলে চুপ করে থাকবে। তৃতীয়ত, ভাবা হয়েছিল চীনের আধিপত্য রুখতে বাকি সবাই এই বিষয়ে চুপ করে থাকবে এবং চতুর্থত, ভারত ভেবেছিল লাখ লাখ সেনা দিয়ে কাশ্মীরিদের মুখ বন্ধ করে উপত্যকার জনবিন্যাসে বদল ঘটাতে পারবে। ইমরান বলেন, ভারতের প্রতিটি অনুমানই ব্যর্থ।

শুধু জম্মু-কাশ্মীরই নয়, রাম মন্দিরের আনুষ্ঠানিক সূচনা নিয়েও মুখর হয়েছে পাকিস্তান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক অন্যায্য রায় মন্দির প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছে। সেই রায়ে আইনের আগে বিশ্বাসকে স্থান দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, করোনার সময় যেভাবে মন্দির তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয় তাতে স্পষ্ট ওই দেশে মুসলমানরা কীভাবে কোণঠাসা হচ্ছে।

রাম মন্দির নিয়ে পাকিস্তানের এই প্রচারের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব আজ এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক মন্তব্য থেকে পাকিস্তানের বিরত থাকা উচিত। যে দেশ সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটায় এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের মুখে এমন মন্তব্য বেমানান।

নথি গায়েব

ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে লাদাখে চীনা ফৌজের অনুপ্রবেশের যাবতীয় নথি উধাও হয়ে গেল। গত মঙ্গলবারেই ওই নথি ওয়েবসাইটে তোলা হয়েছিল। আজ বৃহস্পতিবার তা উধাও।

সরকারি ওয়েবসাইটে ওই নথির শিরোনাম ছিল ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) চীনা আগ্রাসন।’ তাতে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের ৫ মে থেকে পূর্ব লাদাখের গলওয়ানসহ এলএসি বরাবর চীনা ফৌজ হানা দেয়। ওই মাসের ১৭-১৮ তারিখে তারা কুংরং নালা, প্যাংগং লেকের উত্তর ধার ও গোগরায় এলএসি অতিক্রম করে।

সেই থেকে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দুই পক্ষেরই হতাহত হওয়া, কোর কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক, কূটনৈতিক আলোচনা, সেনা অপসারণ, সেনা সংখ্যা হ্রাসের প্রসঙ্গও ওয়েবসাইটে তোলা হয়েছিল। চীনের একতরফা অনুপ্রবেশের ফলে স্পর্শকাতরতার সৃষ্টি হওয়ার প্রসঙ্গও নথিতে ছিল। কিন্তু আজ সকাল থেকেই সেই নথি বা তথ্যাদি ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে গেছে। লিংকটাও অকেজো হয়ে রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাতে সংবাদ সংস্থা জানায়, ওই কাজ তাঁরা করেননি।

গলওয়ান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, চীনা সৈন্যরা সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে আসেনি। ভারতীয় কোনো ঘাঁটিও তারা দখল করে রাখেনি। মোদির ওই মন্তব্য নিয়ে বিপুল হইচই হয়। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলেন, চীনা ফৌজ অনুপ্রবেশকারী না হলে ভারতীয় জওয়ানরা মারা গেলেন কী করে? তা হলে কি ধরে নিতে হবে সংঘর্ষ চীনের সীমানায় হয়েছে? মোদির মন্তব্যকে হাতিয়ার করে চীনও জানায়, তারা সীমান্ত লঙ্ঘন করেনি।

প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে মান্যতা দিতেই কি তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি নথি থেকে চীনা অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ মুছে দেওয়া হলো—এ প্রশ্ন কিন্তু উঠে গেছে।